‘শোলে’ নামটা শুনলেই মাথায় আসে গাব্বার সিং। আর তার সেই বিখ্যাত ডায়লগ ‘কিতনে আদমি থে?’ কিংবা ‘বাসান্তি ইন কুত্তোকে সামনে মাত নাচনা’ কিংবা ‘চল ধান্নো আজ তেরি বাসান্তিকা ইজ্জাত কা সাভাল হ্যয়’। শোলে (১৯৭৫) হলো হিন্দি সিনেমার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। বলতে হয়, ভারতীয় সিনেমার জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। সে নক্ষত্র আমরা টিভি সেটের পর্দায় দেখতে পাই। ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমামালিনি- তাদের অভিনয় দক্ষতা দেখে আমরা হই মুগ্ধ। অথচ এরও আড়ালে যে আরও কিংবদন্তি রয়েছে– তা যেন আড়ালেই থেকে যায়। তাদেরই একজন রেশমা পাঠান।
রেশমা পাঠান আসলে কে? তার পরিচয়টাই আগে দিতে হয়। তিনি হলেন, ভারতীয় সিনেমার প্রথম স্টান্ট নারী। তার আগে নায়িকাদের স্টান্টগুলো করে দিতো পুরুষরা। নারী সাজিয়ে স্টান্ট করানো হতো। কিন্তু রেশমা এসে বাজিমাত করে নেন। এই ‘স্টান্ট উইম্যান’ ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে যোগ করেন নতুন এক অধ্যায়। অথচ কতটা আড়ালেই রয়ে গেছেন রেশমা পাঠান। তাকেই সামনে নিয়ে এলো জিফাইভে (Zee5) মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘দ্য শোলে গার্ল’ (২০১৯)।
বলিউড গত কয়েকবছর ধরেই নারীদের কীর্তি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে। শুধু যে কীর্তি তা নয়, নারীদের সংগ্রামগুলোও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলছে ভারতীয় নির্মাতারা। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে প্রটোগনিস্ট চরিত্রে পুরুষদের আধিপত্য ছিল, সেখান থেকে অনেকটাই নিজেদের সরিয়ে আনছে বলিউড। তারই ধারাবাহিকতায় ফাইজাল আখতার এবং শ্রাবনী দিওদারের লেখায় ‘দ্য শোলে গার্ল’ পরিচালনা করেছেন আদিত্য সারপোদার।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয়, শোলে সিনেমায় হেমামালিনির একটি দৃশ্য দিয়ে। যেখানে দেখানো হয়, ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে শত্রুদের থেকে ভাগছেন তিনি। আর নিজের ঘোড়া ধান্নোকে বলছেন, চল ধান্নো আজ তেরি বাসিন্তিকা ইজ্জাত কা সাভাল হেয়। ঠিক ওই সময় ঘোড়ার গাড়ি উল্টে যায়। দৃশ্যটিকে পরিচালক বলেন ‘কাট’। আর উল্টে যাওয়া গাড়ি থেকে বের করে আনা হয় অন্য এক নারীকে। তিনি হেমামালিনি নন। তার হয়ে যেই নারীটি স্টান্ট করছিলেন– সেই রেশমা পাঠান।
শুরু হয় তার গল্প। আহত রক্তাক্ত বিছানায় পা ভেঙে কাতর রেশমা পাঠান। আমরা দেখতে পাই, এক অপ্রতিরোধ্য নারীকে। যে কিনা অভাবের তাড়নায় স্টান্ট করে রাস্তায় খেল দেখিয়ে উপার্জন করে। তার আগে ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারান। সেই পরিবারে ছোট ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাস্তায় স্টান্ট করার সময় ফাইট ডিরেক্টর এস. আজিমের নজর কাড়েন। তাকে জিজ্ঞেস করে, তুই আর কী কী পারিস? সঙ্গে সঙ্গে রেশমা তার সকল এথলেট দেখিয়ে দেন আজিমকে। ব্যস! হয়ে গেলো রেশমার সুযোগ।
বলিউডে নিজের অভিষেকের সুযোগ করে দেন এস আজিম। কিন্তু কর্মক্ষমতা হারানো গরিব মুসলিম পরিবারের সন্তান রেশমা। তার পক্ষে সিনেমায় যাওয়া কি সম্ভব? এটা কি সমাজ মেনে নেবে? বাবার সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্বও উঠে আসে সিনেমা। তবুও সংসার বাঁচাতে কাজে ঠিকই যোগ দেয় রেশমা।
পৃথিবীর অধিকাংশ নারীদের কর্ম জায়গায় সংগ্রামটা একই। মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের লিঙ্গের পরিচয়। তারা যে নারী! নারীরা কি সব পারে? কিন্তু রেশমা তো পারছে! এটা তো বড় সমস্যা পুরুষের। এত ভয়ঙ্কর স্টান্ট করে, কোমর ভেঙে, রক্তপাত করেও রেশমারা পিছু হটে না। তাদের সংগ্রামে কোনো কোনো পুরুষ পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু অধিকাংশ পুরুষের আপত্তির তো শেষ নেই। সেটা সমাজ হোক, সেটা কর্মের জায়গায় পুরুষ হোক। কেউ গায়ে হাত দেবে, কেউ চরিত্রে হাত দেবে- এটাইতো নারীদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়।
তবুও অপ্রতিরোধ্য রেশমারা কি আটকে থাকে? না, রেশমা বীর দর্পে এগিয়ে যায়। এমনকি একটা সময় রেশমা দেখলো, পুরুষ স্টান্টরা তার চেয়ে বেশি মাইনে পায়। অথচ তাকে দেয়া হয় জুনিয়র আর্টিস্টের মাইনে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ওঠে রেশমা। বলে দেন, ন্যায্য মাইনে না দিলে তিনি কাজ করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গ আসে মুভি স্টান্ট অ্যাসোসিয়েশনের। সে জানতে পারে, এই অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার না হলে পুরুষের সমান মাইনে সে পাবে না। সাময়িক ওই সিনেমার প্রযোজক তাকে ন্যায্য পাওনা দিলেও রেশমার মাথায় ঢোকে অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু সেটা তো পুরুষের দখলে! নারীরা কি সদস্য হতে পারবে?
ঠিক ঠিক ভারতের মুভি স্টান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ আদায় করে নেন রেশমা। হয়ে যান এই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম নারী সদস্য।
নারীদের সংগ্রামটা খুব কঠিন। পদে পদে বাঁধা-বিপত্তি আর সমাজের শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খল ভাঙায় তাদের পাশে অনেকেই দাঁড়ায়। কিন্তু সংগ্রামটা, লড়াইটা তো তার একারই থাকে। নারীরা সমাজে যে জায়গা করে নিয়েছে কিংবা নিচ্ছে তাদের তাদের লড়াইয়ের মাধ্যমে– কোনো পুরুষ সেচ্ছায় কিংবা স্ব-ইচ্ছায় অধিকার দেয়নি। নারীকে চিৎকার করতে হয়েছে, সংগ্রাম করতে হয়েছে, অপ্রতিরোধ্য হয়ে নিজের ন্যায্য হিস্যা আদায় করে ছেড়েছে নারীরা।
রেশমা পাঠানকে তো আমরা কেউ-ই চিনতাম না। অথচ কী আশ্চর্য! রেশমা এমন এক যুগের সূচনা করেছিল বলিউডে- যার ফলই হলো আজকের ‘দ্য শোলে গার্ল’ সিনেমা।
এই সিনেমায় রেশমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিদিতা বেগ। অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন রেশমার চরিত্র। তার চাল-চলন, কথা বলার ধরন সব কিছুই যেন রেশমার সঙ্গে মেলে- সেই কসরত তিনি করেই গেছেন।
আমি সিনেমাটি দেখার পর থেকে ভাবছি, বাংলাদেশে ক্যামেরা পেছনের কাজ করা নারীদেরও নিশ্চয়ই এমনই গল্প আছে। তাদের গল্পগুলো আমরা কি কখনও জানবো না? কে প্রথম নায়িকার পেছনে দাঁড়িয়ে নেচেছে, কে প্রথম নারী হয়ে প্রথম স্টান্ট করেছে। কে প্রথম বাংলাদেশি সিনেমায় নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাদেরও তো সংগ্রাম আছে। সমাজের সঙ্গে সংগ্রাম করা ছাড়া এরা কেউ তো সিনেমার নায়িকা হয়ে উঠেনি।