ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ক্যারিয়ার ওয়ার্কশপ হতো। সেখানে বিশেষ ক্ষেত্রে কাজ করা একজন অ্যালামনাইকে (সাবেক শিক্ষার্থী) নিয়ে আসা হতো। তিনি তার সেক্টরের কাজ নিয়ে সবার সঙ্গে শেয়ার করতেন। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধারণা পেত কোন সেক্টরের অবস্থাটা কী। সেশনগুলো খুব উপভোগ্য ছিল। মজার বিষয় ছিল আমাদের জিজ্ঞাসা থাকতো, গ্রেড কি খুব বেশি জরুরি? আমরা চাইতাম, বলা হোক, নাহ গ্রেড খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়।

যাইহোক, আমি আর নাজমুল হাসান হিমেল একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। হিমেল আমার দুই বছরের ছোট, তবে বড়-ছোট সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই। আমরা বন্ধুর মতই। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, আড্ডার ফলেই এটা হয়েছে। আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে ছোট থেকে বড় সবাই রয়েছে।

হিমেল ডিজিটাল মার্কেটিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। আমি ভাবলাম, এই সেক্টরটা সম্পর্কে একটা ধারণা নিলে কেমন হয়? আমিও জানলাম একই সঙ্গে যে পাঁচ ছয়জন আমার ব্লগটাতে একটু নজর দেন তারাও কিছু জানলো।

হিমেলকে বললাম, আমরা আড্ডার মতো করেই বিষয়টা জানবো। যেন আগ্রহীরা ডিজিটাল মার্কেটিং ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু ধারণা পায়।  

তার আগে বলে নিই, হিমেল এখন কাজ করছে আবুল খায়ের গ্রুপে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের একটা ইউনিট লিড করছে।  

প্রথমেই হিমেলকে জিজ্ঞেস করলাম, শুরুটা কিভাবে? উত্তরে বললো, ‘শুরুটা অনেক আগেই, ‘ওয়েবপার্স’ থেকে, ২০১১ সালে। বাংলাদেশে যে এজেন্সিগুলো ডিজিটাল মার্কেটিংকে ফোকাস করে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ‘ওয়েবপার্স’। তখন আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল, ইউনিলিভার, স্কয়ার, প্রাণ, রেকিট বেঙ্কিজার, রবি আজিয়াটা সহ অনেকের জন্যই কাজ করার। সেখানেই ছিল হাতেখড়ি। ওয়েবপার্সের কর্ণধার জুয়েল ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় এই সেক্টরেই ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই।

পরে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিজিটাল মার্কেটিং টিমে জয়েন করি ২০১৫ সালে। সেখানে ৪ বছর কাজ করি হেড অব অপারেশন্স হিসেবে। আমি এবং আমার ডিপার্টমেন্ট হেড মিলে গড়ে তুলি একটি ইন-হাউজ এজেন্সি ‘ও অ্যান্ড জি সলিউশনস’।  ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলাম প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে।’

আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সার হয়ে পড়ি। তাই সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করে বসলাম, ধরো নিজের ক্যারিয়ার ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কেউ টার্ন করাতে চায়। তাকে কী কী করতে হবে? ধাপে ধাপে বলো।

এর উত্তরে বলল, ‘ ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ টার্মটি থেকেই বুঝা যাচ্ছে এই সেক্টরটি মার্কেটিংয়েরই একটা অংশ। ডিজিটাল মার্কেটিংয়েরও কিন্তু অনেকগুলো এরিয়া আছে কাজ করার জন্য। যেমন ধরেন, কেউ আছে খুব ভালো কন্টেন্ট লিখতে পারে, তার জন্যও কিন্তু কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। আবার কেউ আছে শখের বশে ছবি আঁকে, কারো  অ্যানালিটিক্যাল স্কিল ভালো, কারো খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে ওয়েব টুলস নিয়ে কাজ করার– প্রত্যেকেই কিন্তু তার নিজ গুণটাকে কাজে লাগাতে পারবে এই সেক্টরে।

এখন আসি, আপনি যেটা বললেন, কেউ যদি এই সেক্টরে কাজ করতে চায় তাহলে কী করতে হবে।  তার প্রথম কাজ হবে এই সেক্টরের কোন অংশটাতে সে কাজ করবে সেটা ঠিক করা।

তারপর একটু রিসার্চ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। ইন্ডাস্ট্রিতে যারা ওই ক্ষেত্রে কাজ করছেন তাদের থেকে কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনা। তারপর হিসেব করে দেখা ফিউচার গ্রোথ কেমন। সবচেয়ে বড় কথা সেলফ কমিটমেন্ট ও ধৈর্য্য থাকতে হবে। আর হলো প্রতিনিয়ত শেখার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

অনেকে মনে করেন, সব ছেড়েছুড়ে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ক্যারিয়ার শিফট করে নিয়ে আসবে। এটা খুব সিকিউরড ক্যারিয়ার। ব্যাপারটা এমন নয়। এখানেও প্রচুর সময় দিতে হবে। লেগে থাকতে হবে। সময়, পরিশ্রম, ধৈর্য্য তিনটা বিষয়ই যে কোনো পেশার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এটা ঠিক একেবারেই ফ্রেশারদের (যারা চাকরিজীবন শুরু করতে যাচ্ছে) জন্য সামান্য ব্যতিক্রম হতে পারে। যাদের শুরুই হবে ডিজিটাল মার্কেটিং দিয়ে তাদের অবশ্য সফলতা পাওয়ার সম্ভবনা বেশি বলে মনে হয়। কারণ তারা হাতে লম্বা সময় পাচ্ছে শেখার।’ 

প্রিয় পাঠক বুঝতেই পারছেন। আমি যে উত্তরটা শুনতে চাইছিলাম সেটা কিন্তু হিমেল দিল না। সে বলল, টার্ন করালেই সফলতা মিলবে বিষয়টা এমন না। তার মানে এখানেও প্রচুর খাটাখাটনির প্রয়োজন আছে। শেখার বিষয় আছে। আমরা যারা ভাবি, আরে একটা কোর্স করে নিলাম তারপর নেমে পড়লাম। এরপর টাকাই-টাকা। আসলে ঘটনা তা নয়।

তবুও দক্ষ হওয়ার জন্য তো সার্টিফিকেশনের প্রয়োজন আছে নাকি?

হিমেল বিষয়টা হেসেই উড়িয়ে দেয়। বলে, সার্টিফিকেট হলো ক্যারিয়ারের অলঙ্কার, আপনিও জানেন। সার্টিফিকেট মানে হলো কাজটা আপনি শিখেছেন। কিন্তু এটা দক্ষতার প্রমাণপত্র নয়। তার মানে আপনাকে দক্ষ হতে হবে। শেখা হলো প্রথম ধাপ। তারপরের কাজটা হলো দক্ষতা অর্জন। এখন সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার জন্য শিখবেন নাকি দক্ষ হওয়ার জন্য শিখবেন?  এর গুরুত্ব বুঝতে হবে। আর দক্ষতার জন্য যদি শিখতে চান তবে অনেক ফ্রি টুলস আছে, ইউটিউব  টিউটোরিয়াল আছে, বিভিন্ন ব্লগ আছে। এসব জায়গা থেকে শেখা শুরু করতে পারেন।

যেমন, ফেসবুকেরও নিজস্ব ফ্রি টুলস আছে। যে কেউ ফেসবুক অ্যাডভার্টাইজিং নিয়ে অনেক ধারণা নিতে পারে। ফেসবুক ব্লুপ্রিন্ট নামে – https://www.facebook.com/business/learn ।

গুগলের এডভার্টাইজিং (ফ্রি সার্টিফিকেশন কোর্স) নিয়ে প্রাথমিক ধারণা নিতে গেলে দেখতে হবে – https://learndigital.withgoogle.com/digitalgarage কিংবা https://skillshop.exceedlms.com/student/catalog/browse

এছাড়া ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে বেসিক ধারণা নেওয়ার জন্য, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস (বেসিস) থেকেও কোর্স অফার করা হয়, যা এই লিঙ্কে গেলেই পাওয়া যাবে- http://seip.bitm.org.bd/। আমার মনে হয়, বেসিক ধারণা নেওয়ার জন্য এগুলোই পর্যাপ্ত। বাকিটুকু কাজ করতে গেলেই হয়ে যাবে।

এছাড়াও এই সেক্টরের ওপর ভালো জ্ঞান থাকাও জরুরি। যেমন, গুগল প্রতিনিয়ত আপডেট করছে, https://www.thinkwithgoogle.com/, ফেসবুক উন্মুক্ত করে রাখছে,  https://www.facebook.com/ads/audience-insights/, বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান দেখতে পারবেন https://www.socialbakers.com/

এছাড়াও আরো অনেক। আসলে একবার শুধু গুগলেই সার্চ দিয়ে দেখেন, পেয়ে যাবেন কত অসংখ্য ওয়েবসাইট আছে।’ 

নাজমুল হাসান হিমেল
নাজমুল হাসান হিমেল

আচ্ছা, কাজ না হয় শিখলেন। তো এখন চাকরির বাজারটা কেমন?

বুলেট পয়েন্টে বললে-  

  • বাংলাদেশ সরকার এই খাতে অনেক গুরত্ব দিচ্ছে।
  • বাংলাদেশেই অনেক মার্কেটিং এজেন্সি, টেক ফার্ম, সফটওয়্যার ফার্ম অনেক কর্মক্ষেত্র তৈরি করছে।
  • ফ্রিল্যান্সিং করে অনেক আয় করা যাচ্ছে
  • দেশের বাইরেঅনেক কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার থেকে সাপোর্ট নিচ্ছে। কিংবা তাদের শাখা অফিস বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করছে।
  • বিদেশি যেসব কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চাচ্ছে তারাই কর্মক্ষেত্র তৈরি করছে।

অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা যত বড় হচ্ছে, ততই কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। শুধুমাত্র নিজের যোগ্যতার জায়গাটা আইডেন্টিফাই করতে হবে এবং ডেডিকেশন থাকতে হবে।’ 

যাহোক, আমাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তারা অনেকেই জানেন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট। পাস করার পর থেকে মিডিয়ায় কাজ করার আগ্রহ ছিল। এজন্য মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে মাস্টার্স করেছি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে মিডিয়াতে সুইচ করে চলে আসি। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, এত টাকা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কেন মিডিয়াতে আসলাম।

অনেকেই মনে করেন, এক সেক্টরের লেখাপড়া অন্য সেক্টরে কাজে লাগে না। বিষয়টা কিন্তু ভুল। যাইহোক, হিমেলও কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু ক্যারিয়ার গড়েছে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে। তাকেও এই বিষয়ে প্রশ্ন করলাম।

তার উত্তর হলো,  ‘আমার একজন টিমমেট ছিল, সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিওলজি বিভাগ থেকে পাস করা। সে এখন খুবই ভালো একটা এজেন্সিতে আছে। একটি ইউনিট লিড করছে। তার মানে যে বিভাগে পড়বেন শুধু সে বিভাগেই আপনি ভালো করবেন বিষয়টা মোটেও এমন নয়। এবার আমার কথা বলি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়তো কখনও ভাবিনি, ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে কাজ করবো।

তবে বলতে পারি, আমার পড়াশোনা ক্যারিয়ার গড়ার কাজে সহযোগিতা অবশ্যই দিচ্ছে। কতটুকু দিচ্ছে বা ঠিক কিভাবে দিচ্ছে সেইটা নির্দিষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বিশ্বাস করি, আমার স্বপ্নের জায়গাতেই আছি।

আমি এমবিএ করেছি। এর পেছনে বিশেষ কোনও কারণ ছিল না। মনে হচ্ছিল করে ফেলি, করে ফেললাম। এরকম। তবে এমবিএ থেকে এমন কিছু লার্নিং আমার ছিল যা অবশ্যই আমার কর্মক্ষেত্রে কাজে দিচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, ভাবার জন্য। এটা যত পড়ালেখা করবো ততই হবে। দিনশেষে আমরা যাই করছি, সেইটা প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিসের ডিমান্ড বাড়ানোর জন্য। বিক্রির জন্য। প্রফিটের জন্য। কোনো পড়াশোনা কিংবা কোনো অভিজ্ঞতাই বৃথা যায় না। জীবনে কোনো না কোনো জায়গায় সেটা কাজে লাগবেই। ’

শেষে এসে জিজ্ঞেস করলাম, এই সেক্টরের বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী? এবং সেটা কীভাবে একজন ফ্রেশার ওভারকাম করবে?

প্রথমত, প্রতিনিয়ত শিখার মন মানসিকতা নিয়েই এই সেক্টরে কাজ করা শুরু করতে হবে। নতুনত্বকে কাজে লাগানো। নিজেকে আপডেট রাখা, খেয়াল করতে হবে অন্যরা কী করছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এখন আমি কী করবো? 

আমার বন্ধু করছে বলে আমিও করবো সেভাবে না ভেবে ভাবতে হবে, আমার ওই সেক্টরে ইচ্ছা আছে কিনা সেইটা ঠিক করা।

‘Fashion’ হিসেবে না নিয়ে ‘Passion’ হিসেবেই নিতে হবে।  

দ্বিতীয়ত, সেলসম্যানশিপ। আগেই বলছিলাম, এইটা কিন্তু মার্কেটিংয়েরই একটি ফোকাসড এরিয়া। আর মার্কেটিংয়ে দিনশেষে হিসেব একটাই– বিক্রি বা লাভের পরিমাণ কী।

তৃতীয়ত, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য খুবই তীক্ষ্ণ সামর্থ্য। আপনাকে অনেক সময়ই ইনস্ট্যান্ট সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কী কথা বলবেন, কীভাবে বলবেন কিংবা কথা বলার পরবর্তীতে ইম্প্যাক্ট কী হবে। তাই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে দেখে দেখে, অনুসরণ করে।

 

ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top