হাঁসের পালকের চেয়েও হাল্কা একটি মৃত্যুর গল্প

শহীদুল জহির ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত নিরব একজন মানুষ ছিলেন। এমনকি বলতে হয়, মৃত্যুর আগে অনেকেই জানতেন না বাংলাদেশের মাটিতে তার মতো ভিন্ন ধারার একজন লেখক ছিলেন। তার অসাধারণ সব গল্প বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেলেও, লেখক শহীদুল জহির লোক-চক্ষুর আড়ালেই জীবন কাটিয়েছেন। তার গল্প লেখার ভিন্নতা পাঠককে নেশাগ্রস্থ করে তোলে।

তার এমনই এক অসাধারণ উপন্যাস “আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু”। প্রথমআলোর বর্ষসেরা বইয়ের খেতাবটি পেলেও শহীদুল জহিরের তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

উপন্যাসটির মূল চরিত্র আবু ইব্রাহীম একজন নির্জন সাধারণ মানুষ। ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী-কন্যা-পূত্র নিয়ে তার মধ্যবিত্ত সংসার। এ মধ্যবিত্ত্ব অবস্থার মাঝেও তার ভেতর কাজ করে এক ধরনের শূন্যতা। যে শূন্যতা খোদ্ শহীদুল জহিরও বু্ঝে উঠতে পারেনি বলেই আমার মনে হয়। হয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ব্যর্থ প্রণয়ের বিষন্নতা কিংবা ছাত্র জীবনের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে নিজের বিচ্যূতি। এসবই হয়তো আবু ইব্রাহীমের শূন্যতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার হয়ত- স্ত্রী মমতার প্রতি তার অব্যক্ত ভালোবাসা যা হয়ত সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। কিংবা মমতাকে বোঝাতে পারে না। কিংবা ব্যর্থ প্রেমের কাঙালপনা সত্ত্বেও আবু ইব্রাহীম এক সময় অনুভব করে, হেলেনকে ছাড়া তো সে এতদিন খারাপ থাকেনি। এ সবই যেন পাঠককে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। হয়ত- লেখক নিজের ইচ্ছাতেই পাঠককে বিভ্রান্ত করতে চায়; হয়ত আবু ইব্রাহীমই বিভ্রান্তময় একটি চরিত্র হয়ে উঠে।

যাইহোক। উপন্যাসের শুরুতেই বলে দেয়া হয় আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুর কথা। সে সময় আবু ইব্রাহীমের লাশ একটি খাটিয়ায় করে তার বেইলী রোডের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ঠিক তখন তার স্ত্রী মমতার অনেক আগের একটি রাতের কথা মনে পড়ে। সে রাতে সারস পাখির ঝাক উড়ে যাচ্ছিল। আবু ইব্রাহীম তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে জেগে তোলে ব্যালকনিতে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে- ‌‍‍”সারস পাখির ঝাক উইড়া যাইতাছে। শোনো।” এই কথা মনে করতে করতে মমতার আরও মনে পড়ে সে তখন বলেছিল, তুমি একটা পাগল।

আবু ইব্রাহীমের দিকে স্ত্রী মমতার এ ধরনের বাক্য উচ্চারণকে কেন্দ্র করে লেখক বলে, আসলে মানুষ কি কখনো পাগল হয়, অথবা পাগল না হয়ে কি পারে?

আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুবিষন্ন আবু ইব্রাহীমের ভেতরে যে একজন রোমান্টিকতার ছোঁয়া ছিল তা আমরা উপন্যাসের শুরুতেই পেয়ে যাই। যদিও তখন আবু ইব্রাহিম মৃত। তার লাশ যাচ্ছে জুমা মসজিদের দিকে। মৃত্যুর কথা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে আমরা গল্পের ভেতর ঢুকে যেতে থাকি। আর তখনই আমাদের পরিচয় হয় তার একমাত্র কন্যা বিন্দুর সাথে। বিন্দু তার অভিমান দিয়ে হাজির হয় উপন্যাসে। বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে চাওয়ার অপরাধে মায়ের বকা খেয়ে বিন্দু অভিমানে গাল ফুলিয়ে ছিল। পিতার মন তা দেখে বুঝে নেয়। আর পিতৃত্বের মন তখন অভিমানের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে মমতাকে। মমতা তার মেয়েকে তখন বেয়াড়া বলে সম্বধন করে। কারণ- বেড়াতে যেতে না দেওয়ার কারণে সে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অভিমানি মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যায় আবু ইব্রাহিম তার চিরপরিচিত স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়েকে নিয়ে এদিক-সেদিক সে ঘুরে বেড়ায়। পিতা-কন্যার এক অপূর্ব সম্পর্ক আবিষ্কার করবে পাঠক। পিতা মেয়ে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হৃদয়ে অনুভব করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থ প্রেমের বিষন্নতা। তারপরও পাঠক এ সময় অনুভব করবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পবিত্রতার সম্পর্কটি কেমন হতে পারে। আর কন্যার পিতার প্রতি ভালোবাসা তখন প্রকাশ পায়- যখন বিন্দুর বান্ধবীর বাবার প্রশংসা শোনার পর আবু ইব্রাহিম প্রশ্ন করে, সে তার ঐ বান্ধবীর বাবার কাছেই থাকবে কিনা। কন্যা তখন জবাব দেয়- আমার আব্বু-আম্মু আছে না?

এভাবেই এগিয়ে যায় উপন্যাস। কন্যার প্রতি অগাধ ভালোবাসা দিয়ে আবু ইব্রাহিম যাত্রা শুরু করে। সেই রাতে মমতার সাথে আবু ইব্রাহিমের ঝগড়া হয়। আর সেই ঝগড়া আর পত্নীর প্রতি হঠাৎ ভালোবাসা উতলে উঠা নিয়ে শহীদুল জহির উল্লেখ করে,

এই জিনিসটি আমাদের প্রায়ই মনে হবে যে, আবু ইব্রাহিম একজন অসুখী লোক ছিল; কিন্তু অন্য কখনো, তাকে যখন আমরা উদ্ভাসিত হাসি অথবা পত্নী প্রণয়ের ভেতর দখব তখন আমাদের মনে হবে যে, আমাদের সিদ্ধান্ত হয়তো সত্য নয়।

এরপরই পাঠক জানতে পারবে হেলেন সম্পর্কে কিছু তথ্য। সেই হেলেন, যাকে আবু ইব্রাহীম তার ভালোবাসার চাদরে জড়াতে চেয়েছিল। হেলেনকে না পাওয়ার এক গ্লানিবোধ তার অন্তরে লালিত ছিল। হেলেনের পরিচয়টি দেয়া হয় ঠিক এভাবে-

একটি মেয়ে ছিল; যার নাম ছিল হেলেন এবং তার সহপাঠী ছিল, সে আবু ইব্রাহীমের অগ্নিস্নানের ব্যবস্থা করেছিল।

হেলেন সম্পর্কে আমরা আরও জানতে পারি যখন আবু ইব্রাহীমের ডায়েরির কথা আসবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আবু ইব্রাহীমের ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। আর সে ডায়েরির পাতা জুড়ে আছে শুধু হেলেন।আবার ডায়েরির বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার স্ত্রী মমতা সব জানে। কারণ, মমতার ডায়েরি লুকিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল। হেলেন সম্পর্কে আবু ইব্রাহীম ডায়েরিতে একটি ঘটনার কথা লিখেছিল। যেমন-

কয়েকদিন হেলেন ক্লাসে না আসায় তাকে দেখার জন্য আবু ইব্রাহীমের মন বড় উতলা হয়; তারপর হেলেনের প্রত্যাবর্তনের পর তাকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলে, আবু ইব্রাহীমের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যেতে চায়; তার অন্ত বেদনায় ভরে থাকে।

শহীদুল জহির এভাবেই হেলেনকে নিয়ে আসে তার উপন্যাসে। এবং পাঠক বুঝে যায় হেলের প্রতি তার কি পরিমাণ অগাধ ভালোবাসা ছিল! এবং আজও সে কি পরিমাণ হেলেনের কাঙালপনা। মনে ভেতর না পাওয়ার বেদনা আবু ইব্রাহিমকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে, লেখক পরিষ্কার করে না তাদের প্রেমের গল্পটি। হেলেনকে আবু ইব্রাহীম কখনও ভালোবাসার কথা জানিয়ে ছিল কি না সেটা আমরা কখনই বুঝতে পারি না। এ জায়গায় আমাদের রেখে দেয়া হয় অন্ধকারে। আমরা শুধু জানতে পারি, হেলেন তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করে নাই এবং সে ব্যর্থ প্রেমের কষ্ট নিয়ে ছ-বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এবং এই কষ্টগুলোর কথা তার ডাইরীতে সে রেখে দিয়েছে।

উপন্যাসের এক পর্যায়ে স্মৃতির পাতা থেকে হেলেনকে বের করে আনেন শহীদুল জহির। বর্তমান বৈবাহিক জীবন দেখাতে হেলেনকে আবারও হাজির করা হয়। হেমন্তের এক বিকেলে আবু ইব্রাহীম তার ব্যালকনি থেকে তাদের কলনীতে হেলেনকে দেখতে পায়। বিন্দুকে দিয়ে সে ডাকিয়ে আনে হেলেনকে। হেলেন আসে। অবাক হয়ে দেখে আবু ইব্রাহিমকে। হেলেন প্রবাসী। বেড়াতে এসেছে দেশে। আর দেখা পায় আবু ইব্রাহীমের। তাদের মধ্যে কথা হয়। মমতার সাথে পরিচয় হয়। যদিও মমতা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। মমতা একধরনের নিরপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। আমরা এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হই যখন আমরা দেখি সেই রাতেই মমতা তার স্বামীর প্রতি অতি-আহ্লাদে ফেটে পড়ে।

মমতা তখন হঠাৎ তার বুকের ভেতর এসে পড়ে, তার মাথায় আর চোখে-মুখে হাত বুলায়, ঠোঁটে চুম্বন করে; তাকে বেষ্টন করে থাকে।

হেলেনের যাতায়াত দিন দিন বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মমতার নিরাপত্তাহীনতা। মমতার ক্ষোভ-কষ্ট সব জমাট বাধতে থাকে তার অন্তরে। অন্যদিকে আবু ইব্রাহিমের অনুভব অনেকটাই খেই হারিয়ে ফেলে। কখনও কখনও সে অনুভব করে- হেলেনকে ছাড়া তো এতোদিন সে খারাপ থাকেনি। আর এই বিষয়ে শহীদুল জহির ব্যাখ্যা দেন-

হেলেনকে ছাড়া সে মরে যায়নি। তার মনে হয় যে, হেলেনের সে প্রেমিক ছিল না, পূজারী ছিল এবং হেলেন দেবীদের মতোই পূজারীকে অবহেলা করতে শিখেছিল।

দেবী এখন পূজারীর কাছে আবার এসেছে। আবু ইব্রাহিমের মনে আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। তবে দেবীরা মাঝে মাঝে পূজারীকে বিভ্রান্ত করবে। এটাই স্বাভাবিক। হেলেনও আবু ইব্রাহিমকে বিভ্রান্ত করে। বিন্দু যখন হেলেনকে ফুফু বলে ডাকে। হেলেন বিন্দুকে বলে, আমি তোমার ফুফু না, খালা।

হেলেনের এই আচরণে আবু ইব্রাহিম বিভ্রান্ত হয়। বিভ্রান্ত হয় মমতাও। আর সে বিভ্রান্ত থেকে মমতা বিনা কারণে একটা অজুহাতে তার সন্তানদের মারধর করে। আবু ইব্রাহিম তখন আরও বিষন্ন হয়ে পড়ে। স্ত্রী-সন্তান-প্রেম সব কিছু নিয়ে আবু ইব্রাহিম চরিত্রটাই আমাদের কাছে বিভ্রান্তীময় হয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে উল্লেখ করা হয়েছে,

….আমরা একটি লোক আবু ইব্রাহিমকে জানতে চাইব। আবু ইব্রাহিমকে কেন আমাদের জানা প্রয়োজন, তা আমরা জানি না, হয়তো বা তাকে জানার কোনো প্রয়োজন নেই, হয়তোবা আছে। তবু তার কথা আমরা জানব এবং শুনব, হয়তোবা শুধুমাত্র এই কারণে যে, আমরা একটি কথা- সাহিত্যের গ্রন্থ পাঠ করতে চাই এবং করলে আমাদের এই গ্রন্থের চরিত্র অথবা চরিত্র সমূহকে জানতে হবে যদিও আমরা জানি যে, পাঠ এবং অনুধাবন কখনো কখনো কষ্টসাধ্য বটে। …..

আবার মমতা বার বার তার ভালোবাসার চাদরে আবু ইব্রাহিমকে জড়িয়ে ধরতে চায়। এভাবেই দুটো নারীচরিত্রের মাঝে মানুসিক দ্বন্দ শুরু হয়। যদিও হেলেনের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু ধীরস্থীর-সংসারী স্ত্রী মমতা নিজের স্বা্মী-সন্তানকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে থাকে। আবু ইব্রাহিম বুঝতে পারে। সেও নিজের আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পারে না। এগুলো বুঝতে পারি তখন যখন দেখি, হেলেনের পিকনিক আয়োজনে আবু ইব্রাহিম সম্মতি দান করে। মমতার অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেখানে যেতে হয়। সেই পিকনিকে এক সময়ে হেলেনের হাতা কাটা লাল ব্লাউজের ভেতরে চোখ যায় আবু ইব্রাহিমের। হয়তো লেখক বোঝাতে চেয়েছেন আবু ইব্রাহিমের যৌন আবেদনের কথা। কারণ, যখন বর্ণনা করা হয় আরেকটু গভীরে গিয়ে।

আবু ইব্রাহিম দেখে গজারি গাছের একটি পাতা খসে গিয়ে হেলেনের মাথার উপর নেমে আসতে থাকে, এই স্থুলিত হলুদ পাতাটি লুফে নেওয়ার জন্য হাত উঠালে শাড়ির নিচ থেকে ব্লাউজ ঢাকা হেলেনের স্তন, এক জ্যোতির্ময় গোলকের মতো আবু ইব্রাহিমের চোখের সামনে প্রকাশিত হয় এবং হেলেন তা বুঝতে পারে।

এরপর আবু ইব্রাহিমের সাথে কিছুক্ষণ হাটার ইচ্ছা ব্যক্ত করে হেলেন। এতে আবু ইব্রাহিম আরও বিষ্মিত হয়। হেলেনের কাছে সে কোন কিছুই কামণা করে নাই। কিছু না চাইতে এই পেয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা বাকি জীবন সে খুজতে থাকে কিন্তু পায় না। এরপর একদিন আবু ইব্রাহিম হেলেককে নিয়ে এক রেস্তরায় যায়। সেই রেস্তরায় হঠাৎ সে তার বন্ধুর বাসায় হেলেনকে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়।

ঠিক এখান থেকেই হেলেন-আবু ইব্রাহিমের সম্পর্কের ব্যবধান বেড়ে যায়। হেলেন যদিও না করেনি। কিন্তু পাঠক কিংবা লেখক কেউ বুঝতে পারে না হেলেনকে ঠিক কি কারণে আবু ইব্রাহিম তার বন্ধুর বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বুঝে উঠতে পারে না স্বয়ং আবু ইব্রাহিমও। সে ভেবে যায় ঠিক কি কারণে সে যেতে বলেছে। এমনকি বন্ধুর বাসায় যাওয়ার আগের দিনও আবু ইব্রাহিম খুজতে থাকে এর কারণ। এক সময় সে নিজেকে নিজে বলে উঠে, আমি তোমাকে নগ্ন করবো। তখন আমরা বুঝতে পারি, আসলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আবু ইব্রাহিমকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। আর সে কারণেই হেলেনকে সে এই প্রস্তাব দিয়েছিল। যদিও সে অনেকটা নিশ্চিত ছিল যে হেলেন বন্ধুর বাসায় আসবে না। তাই আবু ইব্রাহিম নিজেও সেখানে যায়নি। সেই দিন বন্ধু নিজে যখন ফোন করে প্রশ্ন করে। তখন সে বুঝতে পারে হেলেনও সেখানে যায়নি। আর এটা শোনার পর সে আবার বিষন্ন হয়ে পড়ে। আর এই বিষন্নতার জন্য আবু ইব্রাহিম যে নিজেই দায়ি তা আমরা সকলেই বুঝতে পারি।সে আরও বিষন্ন হয়ে পড়ে যখন সে হেলেনের চিঠি পায়। যেখানে লেখা- আমি তোমাকে কখনো কষ্ট দিতে চাইনি ইব্রাহিম।তার এই নিজের তৈরী করা বিষন্নতা নিয়ে শহীদুল জহির আবু ইব্রাহিমকে গ্রীক চরিত্রগুলোর মতো উল্লেখ করে। যারা নিয়তির দ্বারা পীড়িত হয় এবং সেই নিয়তিকেই বহন করে চলে।

হেলেনের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির নারী চরিত্রগুলোর মাঝে শেষ হয় দ্বন্দ। এরমাঝে যদিও চাকুরীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলে লেখক। শুধুমাত্র পেটের দায়ে চাকরী চালিয়ে যাওয়া ইব্রাহিম প্রায়ই হতাশ থাকে। অফিসের সিদ্দিক হোসেন অত্যন্ত বাস্তববাদিতার মধ্য দিয়ে চরিত্রটি বেড়ে উঠে। সেই প্রথম হাউজিং ডিপার্টমেন্টের রুপনগরের প্লটের জন্য আবু ইব্রাহিমকে অ্যাপ্লিকেশন করতে বলে। চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। এই জন্য কিছুটা চিন্তায়ও পড়ে সে। তাই শশুরের কাছ থেকে কিছু সাহায্য নেয়ারি কথা ভাবতে থাকে। এরই মধ্যে তার সাথে পরিচয় হয় খালেদ জামিল নামে এক ব্যবসায়ির। নিজের টেন্ডার পাইয়ে দেয়া প্রসঙ্গে সে আবু ইব্রাহিমকে হাত করার চেষ্টা শুরু করে। একসময় আবু ইব্রাহিমকে সে ত্রিশ হাজার টাকার ঘুষ দিয়ে দেয়। আবু ইব্রাহিম তা নিয়ে বাসায় যায়। ঠিক এরপর আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করব আবু ইব্রাহিমকে। খালেদ জামিলের কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা থাকলেও এক নতুন খেলা শুরু করে আবু ইব্রাহিম। যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার পাইয়ে দেয় সে। যা দেখে অনেকটাই বিষ্ময় প্রকাশ করে খালেদ জামিল। একসময় সে তার ঘুষের টাকা দাবি করে। এবং তখন আবু ইব্রাহিম, কিসের টাকা? প্রশ্ন করলে, খালেদ জামিলের মতই পাঠকরাও বিষ্মিত হবে। এরপর আবু ইব্রাহিমের খেলা আরও বাড়তে থাকে। খালিদ জামিলও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। বারবার সে আবু ইব্রাহিমের সাথে দেখা করে। এবং তার টাকা ফেরত চায়। এবং ঠিক একই প্রশ্ন আবু ইব্রাহিমের, টাকাটা কিসের?

আবু ইব্রাহিম কেন এই খেলা খেলে তা আমরা কেউ বুঝতে পারি না। পাঠক বুঝতে পারে না। লেখক বুঝতে পারে না। হয়তো আবু ইব্রাহিমই জানতো যে সে কেনো এ ধরনের খেলা খেলছে। একটা সময়ে সে টাকা ফেরত দিতে স্বীকৃতি জানায়। তাও অফিসে নয় জিপিওর সামনে সে পরদিন সকাল দশটায় আসতে বলে খালেদ জামিলকে।

পাঠক অপেক্ষা করে, হয়ত এই খেলার রহস্য ঠিক তখনই উন্মোচিত হবে সকলের সামনে। পরিষ্কার হবে এই খেলার কারণ। কিন্তু না। একটি নিছক সাধারণ অপ্রত্যাশিতভাবে আমরা দেখতে পাই ছিনতাইকারীদের গুলির আঘাতে আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু। চমৎকার গল্পটির প্রধান চরিত্র, বিষন্ন চরিত্রটির মৃত্যু এতই সাধারণ হবে তা খোদ লেখকও হয়ত প্রত্যাশা করেনি। আর তাই তো- লেখক বলে উঠেন,

এভাবে হাসের পালক খসে পড়ার চাইতেও হাল্কা এবং তুচ্ছ এক মৃত্যু আবু ইব্রাহিমকে গ্রাস করে এবং তাকে নিয়ে সঙ্গত কারণেই আমাদের আর কোনো আগ্রহ থাকে না; তাতে আমরা বিষ্মিত হই।

এতো হাল্কা মৃত্যু- এতো নিছক মৃত্যু পাঠককে থমকে দিবে। আরও থমকে দিবে এই কারণে যে, যখন দেখবে কারও মৃত্যু কাউকে থমকে দেয়না। আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু কম বয়সী মমতার দ্বিতীয় বিয়েকেও থমকে দিতে পারেনি। আবু ইব্রাহিমের সেই মমতা যে কিনা স্বামীর প্রাক্তণ প্রেমিকাকে দেখে মনের ভিতর আগুন ধরিয়েছিল। যে কিনা আবু ইব্রাহিমকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল নিজের করে। সেই মমতা মৃত আবু ইব্রাহিমের কবর নিয়ে বাকি জীবন কাটাবে এটাতো আর সম্ভব নয়।আবু ইব্রাহিমের যেন আবারও নিজের নিয়তিকে মেনে নিতে হলো। একমাত্র মমতা চলে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তার কবর। যে কবরে এখন নির্জন রাতে আরও নির্জনতা নেমে আসে, সে নির্জনতায় পেচার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। অবহেলায় একসময় আবু ইব্রাহিমের মৃত্যুর মতই তার কবরস্থানের কথাও আমরা ভুলে যাই।আমরা তখন অনুভব করতে পারি মানুষের জীবনের আনন্দ-বেদনা-চাওয়া-পাওয়া-আকাঙ্ক্ষা এই সব নিছক একটা খেলা মাত্র। যে খেলায় কোন জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা হয় না। আমরা ভেবে নেই আমাদের জয় হয়েছে কিংবা পরাজয় হয়েছে। আসলে আমরাও সেই গ্রিক চরিত্রগুলোর মতই। আমরা আমাদের নিয়তীকে বহন করে চলি। এর বেশী আর কিছুই না।

লেখক শহীদুল জহিরের এই অনবদ্য সৃষ্টি পাঠক সমাজকে নাড়া দিয়ে যাবে। পাঠককে বারবার নেশায়-রহস্যে আকড়ে ধরবে। কোন চরিত্রকে তাচ্ছিল্য করে দেখার উপায় নেই এই উপন্যাসে।শুধুমাত্র তার পূত্র সন্তানটি নিয়ে খুব একটা কিছু বলেনি সে। এছাড়াও শহীদুল জহিরের লেখার ধরণের ভিন্নতা পাঠক দেখতে পাবে বার বার। তার অধিকাংশ বাক্যে- হয়তো, অথবা, তবে, কিংবা, হয়তোবা…. এই শব্দগুলো একটা ভিন্নমাত্রা যোগ করে।

———————————————————

উপন্যাস: আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু

লেখক: শহীদুল জহির।

প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯

প্রকাশক: আহমেদ মাহমুদুল হক, মাওলা ব্রাদার্স

প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

দাম: ৮০ টাকা

হাঁসের পালকের চেয়েও হাল্কা একটি মৃত্যুর গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top