গল্প: দেশ

যখন সিদ্ধান্ত নিলাম চিকিৎসার জন্য ভারত যাবো, তখন থেকেই আত্মীয়স্বজনের কত না প্রশ্ন! কেউ কেউ তো ‘ফুটানি মারছি’ বলতেও ছাড়েনি। কাউকে বোঝাতে পারলাম না- আরে বাবা, আমার পেট খারাপ রোগটা এই দেশের কোনো ডাক্তারই সমাধান দিতে পারছে না। তো ভারত না গিয়ে করবো কী? অত তো টাকা নেই যে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যাবো। যদিও বাংলাদেশের ডাক্তাররা আইবিএস মানে ‘ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রম’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমার আপত্তি হলো, ডাক্তার তো আমার কথাই শুনে না। পেট খারাপ বলা মাত্রই বলতে শুরু করে আপনার আইবিএস। কিংবা একগাদা টেস্ট লিস্ট ধরিয়ে দেয়। এই নিয়ে অবশ্য আমার বন্ধু আকবর হাসতে হাসতে বলেই ফেলেছিল, ‘তুই তাহলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেই ইন্ডিয়া যাবি?’

-হ্যাঁ, যদি তাই মনে করিস, তাহলে এজন্যই যাচ্ছি।

যাহোক, আত্মীয়স্বজনের ঘ্যানঘ্যান-প্যানপ্যান পেছনে ফেলে ঠিক ঠিক প্লেনে চেপে রওনা দিলাম ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে। এটা আমার প্রথম বিদেশযাত্রা। তাই একটু ঘাবড়ালেও ইংরেজি যেহেতু জানি, আশা করছিলাম সমস্যা খুব একটা হবে না। ইমিগ্রেশনে যে অফিসার আমার পাসপোর্ট দেখছিলেন তিনি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশে তুমি কোথায় থাকো?’

-ঢাকায়। উত্তরা।

তিনি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা তো চিনি না, তুমি নাজিরাবাজার চেনো?

আমি বিস্মিত হয়েই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা তো পুরান ঢাকায়। তুমি কি গিয়েছিলে কখনো?

ততক্ষণে তার কাজ শেষ। আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দিতে দিতে বললেন, না যাইনি। শুনেছি অনেক গল্প।

আমি সামনে এগিয়ে এলাম। পেছনে লম্বা লাইন। আমার প্রশ্নও তো শেষ হয়নি। তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, কার কাছ থেকে গল্প শুনেছো?

সে তখন আমার পেছনের মানুষটার পাসপোর্ট নিতে নিতে মাথা নিচু করে বলছে, দাদির কাছে শুনেছি। ওনাদের বাড়ি ছিল ওখানে।

গল্পটা এগোনোর সুযোগই নেই। ততক্ষণে আমাকে ইশারায় সে বলতে চাইলো, দ্রুত সরে যাও।

তার কথা বলার খুব একটা আগ্রহ নেই হয়তো, কিংবা বলতে চায়ও না।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে খুব একটা কষ্ট হবে না জায়গা মতো পৌঁছাতে। অ্যাপোলো আবার তাদের বিদেশি রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখে। তারা কমপ্লিমেন্টারি পিকআপ দেয়। অর্থাৎ এয়ারপোর্ট থেকে যে হোটেলে যাবো সেখানে পৌঁছে দেবে তাদের নির্ধারিত গাড়ি।

বের হয়েই দেখি একজন সাদা পোশাকের লোক মিস্টার জুবায়ের হোসেন লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে গিয়ে নিজের পরিচয় বলতেই সে আমার পাসপোর্ট দেখতে চায় এবং অ্যাপোলো আমাকে যে চিঠিটি দিয়েছে সেই কপিটিও দেখতে চায়। সব দেখে সে লাগেজ নিজেই নিয়ে রওনা দেয় পার্কিংয়ে। সেখানে যেতেই তাকে ঠিকানা দেখাই হোটেলের।

এলাকাটার নাম ট্রিপলিকেন রোড। হোটেলের নাম হলো রাজ। সমস্যা হলো গাড়িতে উঠেই আমি বুঝে ফেলি, লোকটা না ইংরেজি, না হিন্দি- দুটো ভাষাই বোঝে না। শুধু ‘ইয়েস-নো’ বলে। তামিল ছাড়া সে কোনো ভাষাই জানে না বোধ হয়। শুধু আমার পাসপোর্ট আর কাগজপত্র দেখলো। মানে নেই।

এ তো মহা বিপদ হয়ে গেলো। প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে সে একটা জায়গায় গিয়ে আওয়াজ করলো ট্রিপলিকেন রোড। আমি তাকে ইংরেজিতে বলি, আমাকে হোটেল রাজে নিয়ে যাও।
সে শুধু মাথা ঝাঁকায়। বুঝতে পারি সে হোটেলটি কোথায়, বলতে পারছে না।

তাকে শুধু বলি, ওয়েট। দেখলাম এটা সে বুঝতে পারলো।

গাড়ি থেকে বের হয়ে ভাবতে থাকি কাকে ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করবো। একজন ভদ্রলোককে দেখলাম, সাদা লুঙ্গি ও সাদা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। চেহারায় একটা স্মার্টনেস আছে। তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, হোটেল রাজটা কোথায় বলতে পারো?

তিনি আমার হাতে থাকা কাগজটা নিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, কিসে এসেছো?

গাড়ি দেখিয়ে বললাম, এই গাড়িতে এসেছি।

তিনি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন, ড্রাইভারকে তামিল ভাষায় বলে দিলেন কীভাবে যেতে হবে হোটেল পর্যন্ত।

তারপর আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছো?

বললাম, বাংলাদেশ। মুহূর্তেই দেখলাম তার চোখ বড় হয়ে গেলো। আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, চমৎকার। তুমি আমাদের সবচাইতে কাছের প্রতিবেশী। বাংলাদেশকে আমরা অনেক ভালোবাসি।

আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়েই গাড়িতে উঠে পড়ি। তারপর গাড়ির গল্গাস নামিয়ে আবার ধন্যবাদ বলতেই লোকটা বলে উঠলো, মনে রেখো ‘৪৭ সালের আগে আমরা সবাই এক ছিলাম। তারপর তোমরা পাকিস্তান হয়েছো, তারপর যুদ্ধ করে বাংলাদেশ হয়েছো। মনে রেখো, একদিন আমরা একই ছিলাম।

আমি তার কথা শুনে স্তব্ধ থাকি কিছুক্ষণ। সত্যিই তো! আমরা তো একসময় একই ছিলাম। একই দেশের মানুষ ছিলাম।

তো, শেষমেশ ঠিকই হোটেলে পৌঁছালাম। হোটেল রাজের বাইরেই এক মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে সাদা লুঙ্গি ও গায়ে চেক চেক শার্ট। আমাকে নামতে দেখে এগিয়ে এলেন। আমার লাগেজগুলো নামাতে নামাতে তিনি বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলেন, কখন নেমেছো?

আমি তো অবাক।

-আপনি বাঙালি?

সে মুচকি হাসি দিল। কিন্তু কিছুই বলল না।

তবে বুঝলাম সে এই হোটেলেরই লোক। হোটেলের ভেতরটা খুব ছিমছাম।

চেক-ইন করার সময় নানান শর্ত জুড়ে দিলো কাউন্টারে থাকা তামিল লোকটা। ইংরেজিতেই আমাকে বললো, রুমে নো স্মোকিং। করলেই জরিমানা। সকালে ব্রেকফাস্ট হবে ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে। রুমে দুই বোতল পানি পাবে প্রতিদিন। এর বেশি লাগলে বিল অ্যাড হবে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই আমার লাগেজগুলো নিয়ে রুম পর্যন্ত দিয়ে এলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী? হেসে বললেন, নারায়ণ। আবার প্রশ্ন করলাম, আপনি কি বাঙালি?

তিনি এবার পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দিলেন। ‘তুমি যে ইংরেজিতে কথা বলো, তখন কি কেউ জিজ্ঞেস করে- তুমি কি আমেরিকান নাকি ব্রিটিশ?’ আমি কিছুটা বিব্রতই হয়ে গেলাম। সত্যিই তো, বাংলা ভাষা জানলেই কি বাঙালি হয়?

২.

পরদিন সকালে নাশতা সেরেই চলে গেলাম অ্যাপোলো। ট্রিপলিকেন রোড থেকে বেশ দূরেই হাসপাতাল। ভুলই হয়েছে। অ্যাপোলোর ধারেকাছে অনেক হোটেল ছিল। আগে জানলে এত দূরে হোটেল নিতাম না। অনলাইনে হোটেল খোঁজা আর সরাসরি একটা জায়গায় এসে বুঝেশুনে হোটেল খোঁজার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। এটা একটা অভিজ্ঞতাও হলো বটে।

সকালে যখন বের হই তখন নারায়ণই আমাকে একটা অটো ঠিক করে দিয়েছিল। ভাড়া নিয়েছিল ৮০ রুপি। অ্যাপোলোতে গিয়ে আমার মাথা তো চড়কগাছ। প্রায় আশি ভাগ রোগীই বাংলাদেশের। আহারে! কত কোটি কোটি টাকা ভিনদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের চিকিৎসকরা যদি একটু আন্তরিক হতেন তবে টাকাগুলো তো দেশেই থেকে যেত।

যাহোক, ডাক্তার আমার সঙ্গে কথা বলে একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে এই জায়গায় খুব একটা পার্থক্য তো দেখলাম না। বললেন, আজকে টেস্টগুলো করে ফেলো। আর কালকে সকালে আসো। কলোনোসকপি ও এনডোসকপি করবো। সঙ্গে অবশ্যই কাউকে নিয়ে আসবে।

পড়লাম তো মহা ঝামেলায়! কাকে আনবো? আমি তো এখানে একাই এসেছি। দুপুর পর্যন্ত ব্লাড টেস্ট, এক্স-রে, আলট্রাসোনোগ্রাফিসহ নানাবিধ টেস্ট করিয়ে হোটেলে আসতে আসতে প্রায় বিকেল। ঢোকার সময়ই খুব খিদে নিয়ে নারায়ণকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাতের হোটেল আছে?

-চিকেন আর ভাত হলে হবে? আমি মাথা নাড়ালাম।

-তুমি রুমে যাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি। আর ১২০ রুপি দাও। তাকে টাকা দিয়ে আমি উপরে চলে গিয়ে গোসল করে এসে শুনতে পেলাম দরজায় নক। খুলে দেখি নারায়ণ দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে খাবার। খুব যত্ন করে খাবার বেড়ে দিল।

বললাম, নারায়ণ তুমি কি কালকে আমার সঙ্গে একটু হাসপাতালে যেতে পারবে? সেও ত্বরিত উত্তরে বলল, কেন অ্যাটেনডেন্ট হতে হবে?

-হ্যাঁ।

-তাহলে আমাকে ২০০ রুপি চার্জ দিতে হবে।

এ কেমন কথা আবার? আমি তাকে বললাম, এটার জন্য তুমি টাকা নেবে?

রাজি হওয়া ছাড়া তো উপায়ও নেই। তাই রাজি হয়ে গেলাম।

৩.

পরদিন নারায়ণ আমার সঙ্গে রওনা দিল অ্যাপোলো। এনডোসকপিতে তেমন কষ্ট না হলেও কলোনোসকপিতে খুব কষ্ট হলো। বিশেষ করে পেটের মধ্যে হাওয়া দিয়ে যখন পেট ফোলাচ্ছিল ওই কষ্টটা নিতেই পারছিলাম না।

আমি বের হতেই নারায়ণ এগিয়ে এসে ধরে আমাকে বসালো। বলল, এখনই কিছু খেয়ো না। হোটেলে চলো। একটু রেস্ট নাও। তারপর খেয়ো।

দেখলাম, নারায়ণ এসব বিষয়ে বেশ পারদর্শী। সে জানে তাকে কখন কী করতে হবে। আমাকে বলল, তুমি দেশে ফিরবে কবে? বললাম, কাল বিকেলে ফ্লাইট।

সে তখন বলল, তাহলে এখনই গতকালের রিপোর্টগুলো নিয়ে নাও। আর আজই বিকেলে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখো। অ্যাপোলোতে এজন্যই আসা। অনেকে বলেছিল, চেন্নাইয়ের ভ্যালোরে সিএমসি হাসপাতালটা ভালো কিন্তু অনেক সময় নেয়। অ্যাপোলো এক্ষেত্রে একটু অন্যরকম। খুব দ্রুত সব কাজ হয়। আমরা যারা চাকরি করি, তাদের জন্য তো ৮-১০ দিন ছুটি পাওয়া মুশকিল। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে ফিরতে তো হবে!

যাহোক, সেদিন নারায়ণকে আমার খুব আপন কেউ মনে হচ্ছিল। সে আমাকে আগলে রেখেছিল পুরোটা সময়। কখনও কখনও মাথায় হাতও বুলিয়ে দিচ্ছিল। বারবার জিজ্ঞেস করছিল, সমস্যা হচ্ছে? বমি আসে?

আমি মাথা নেড়ে বলছিলাম, না। এমনকি হোটেলে এসেও দেখলাম, সে আমাকে রুমে দিয়ে নিজ খরচায় খাবার নিয়ে এলো। তাও ভারি কোনো খাবার নয়। স্যুপ নিয়ে এসেছে।

বলল, ভারি খাবার আরও কিছুক্ষণ পর খেয়ো। এখন স্যুপ খাও। বিকেলে যখন ডাক্তারের কাছে যাবো, তখন দেখলাম সেও নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, চলো তোমাকে নিয়ে যাই।

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, এটার জন্য কত দিতে হবে? হেসে দিয়ে বলল, হিসাবকিতাব পরে হবে, এখন চলো।

ভারতীয় ডাক্তারদের চেয়ে বাংলাদেশি ডাক্তারদের সবচাইতে বড় তফাৎ হলো, তারা ধৈর্য নিয়ে রোগীর কথা শোনে। রোগীর সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। যেমন, দীর্ঘদিন পেট খারাপ শোনা মাত্র বাংলাদেশের অনেক ডাক্তার আমাকে বলে দিয়েছিল, আপনার আইবিএস। যে খাবার খেলে পেট খারাপ হয়ে যায়, সেগুলো খাবেন না।

আর এখানে ডাক্তার শুরু থেকেই আমার সব কথা শুনেছেন। রিপোর্ট দেখে তার প্রথম কথাই ছিল, তুমি পুরোপুরি সুস্থ। কোনো সমস্যা নেই। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম, কিন্তু আমি তো গত দুই মাস কিছুই খেতে পারছি না। পেট খারাপ হয়ে যায়। দেশে যে বলল, আইবিএস। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ এটা আইবিএস। কিন্তু এটা ভেবে তুমি ডিপ্রেশনে থাকবে না। তুমি সবই খাবে। তবে পরিমাণমতো। কতটুকু খেলে তোমার পেটে গণ্ডগোল হয় সেটা খেয়াল করবে। ব্যস, তাহলেই সব ঠিক। আর এটা নিয়ে চিন্তাই করবে না। ব্যায়াম করবে, যত পারো রিলাক্স থাকবে, বাইরের খাবার এড়িয়ে চলবে- দেখবে এক বছরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। এই এতটুকুু কথা বাংলাদেশে কেউ বললে, এত খরচ করে বিদেশ আসা লাগতো?

যাহোক, নারায়ণকে নিয়ে হোটেলে ফেরত গেলাম খুবই ফুরফুরে মেজাজে। তাকে বললাম, আজ তোমার সঙ্গে আড্ডা দিব, চলে আসো। একটা রাতই তো আছে।

রাত প্রায় ১০টায় নারায়ণ হাজির। সে বলল, চলো আজকে তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো। আমার মেয়েরা তোমাকে দেখতে চায়। তোমার গল্প করেছি।

নারায়ণের বাসাটা হোটেল রাজ থেকে একটু এগিয়ে গেলে পাশের গলিতেই। জীর্ণশীর্ণ একটা বাড়ি। ঢাকায় কলোনিগুলো যেমন, ঠিক তেমন। তিন কামরার আঁটোসাঁটো বাসা। অদ্ভুত বিষয় হলো, তাদের বাসায় গিয়ে দেখি সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। কী অদ্ভুত! নারায়ণের দুই মেয়ে। একজন পড়ে ক্লাস ফোরে, আরেকজন ক্লাস নাইনে। ছোট মেয়ের নাম নালা নারায়ণ, বড় মেয়ের নাম নায়াম নারায়ণ। ছোট মেয়েটা খুব মিশুক। তার বাংলাও একদম স্পষ্ট। তবে বড় মেয়েটা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। তাদের মাকে দেখে সাউথ ইন্ডিয়ানই মনে হলো। তার পুরো নাম যদিও জানা নেই, তবে নারায়ণকে দেখলাম তাকে রাইনিথা নামে ডাকতে। সম্ভবত ওটাই ওনার নাম। তিনি খুব হ্যাংলা-পাতলা গড়নের। বয়স খুব বেশি হলে ৩৪-৩৫ হবে। তবে খুব তেজি। দেখলাম মেয়েদের কিছুক্ষণ পরপর ধমকের সুরে কী যেন বলছেন। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমার বাড়িতে আসাটা তিনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না।

নারায়ণের ছোট মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। রাতের খাবার যখন টেবিলে এলো, খেতে গিয়ে খেয়াল করলাম, দেয়াল পুরোনো আমলের একজনের ছবি। সাদাকালো, ছবিটা ঝাপসা হয়ে গেছে বয়সের ভারে।

আমি নারায়ণকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে? আপনার বাবা?

নারায়ণ হাসলেন। বললেন, না না। তুমি খেয়ে নাও।

আমার কেন যেন মনে হলো, নারায়ণ কথা ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আমি দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতেই দেখলাম, নারায়ণের স্ত্রী কী কী যেন বলেই চলেছেন। টেবিলে বসা সবাই অনেক চুপচাপ হয়ে গেলো। তাদের ভাষা তো বুঝি না, কিন্তু মানুষের মুখে অনেক কথার ছাপ তো পড়ে যায়।

৪.

সে রাতে নারায়ণের বাসায় ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। খুব খারাপ লাগছিল তার স্ত্রীর ব্যবহারে। পরদিন যখন হোটেল থেকে বের হই লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবো বলে তখন নারায়ণ এসে দাঁড়ায়।

তাকে আমি ১ হাজার রুপির একটা নোট দিয়ে বলি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে সহযোগিতা করেছেন।

নারায়ণ টাকাটা না নিয়েই আমাকে বলল, আমি কি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারি দাদা?

আমি কিছু বলি না। চুপ করে ছিলাম। দেখলাম নিজে থেকেই ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো। আমি পেছনের সিটে। সামনের সিটে নারায়ণ।

কিছুক্ষণ ট্যাক্সির চাকা ঘোরার পর নারায়ণ জিজ্ঞেস করলো, কাল রাতের জন্য দুঃখিত। আমার স্ত্রীর ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করে দিও। আমি তখনও কিছু বলিনি। চুপ করে ছিলাম। সত্যিই খুব অপমানবোধ করেছি গতকাল। স্ত্রী চায়নি, তবুও নারায়ণ কেন আমাকে তার বাসায় নিলো বুঝতে পারলাম না।

এয়ারপোর্ট প্রায় কাছাকাছি তখন হুট করেই নারায়ণ বলে উঠলো, কাল দেয়ালে যে লোকটার ছবি দেখেছো, তিনি হলো গিয়ে আমার দাদার বাবা। আমি তাকে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, দাদার বাবা? হ্যাঁ। ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ আইন হয়, তখন তিনি এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন। তিনি থাকতেন পূর্ববঙ্গে। বাবার কাছে শুনেছি তিনি থাকতেন সম্ভবত বুড়িগঙ্গা নদীর আশেপাশে কোথাও। ওই আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি জেলেও গিয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও করেছেন, গান্ধীজির ভক্ত। বাবা এই ছবি যত্ন করে রেখেছিলেন। আমিও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। বাবা গর্ব করে বলতেন, আমার বংশে শহীদ আছে। এর চাইতে বড় পাওনা আর কী?

আমি শহীদ শব্দটা শুনতেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম, শহীদ হয়েছিলেন?

-হ্যাঁ। সম্ভবত ১৯৩০ কিংবা ‘৩১-র দিকে ওনার লাশ পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গায়। এই ছবিটা কে কখন কীভাবে তুলেছে সে গল্পও আমরা জানি না। আমি তখনও চুপ করে আছি। এত পুরোনো একটা ছবি দেয়ালে। সেটা নিয়ে বাসায় এত ঝগড়াঝাঁটির বিষয়টি আমি বুঝতে পারছিলাম না তবুও।

নারায়ণ আবার বলে উঠলো, আমাদের বাড়ি ঢাকায়। ওই বুড়িগঙ্গার আশেপাশেই ছিল। ‘৪৯ সালে আমার দাদা চলে আসে এখানে। পরিবারে দাদা ছিল একা একজন পুরুষ। বাকি সবাই ছিল নারী। দাদার বোনই ছিল ৬ জন। পুরো পরিবার তখন দাদার ওপর নির্ভর। দেশভাগের ওই সময়ে তো হিন্দুস্থানে মুসলমান, আর বঙ্গদেশে হিন্দুদের জন্য থাকাটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। কাছের মানুষই অনেক দূরের হয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাসার লোকজনই যেন অপরিচিত। যেন দেশ তখন ধর্মের হয়ে গেছে, মানুষের না। তখনই দাদা সবাইকে নিয়ে প্রথমে কলকাতায় আসেন। সেখানে রিফিউজি কলোনিতেই সংসার গড়েন। আমার বাবা সম্ভবত ‘৭২/৭৩-র দিকে চলে আসেন চেন্নাই। আমার মা সাউথেরই ছিলেন।

আমার বাবা বলতেন, দেশ তো হারাইলাম, অন্তত ভাষাটা টিকাইয়া রাখিস। এজন্য আমার অন্য ভাইবোনরাও বাংলা জানে। আমরা চেষ্টা করেছি, ভাষাটা নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে। এটা নাকি দাদাই বাবাকে বলে গিয়েছিলেন। অন্তত ভাষাটা যেন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকে। ভাষা বেঁচে থাকলে নাকি অন্তরে দেশটাও বেঁচে থাকে। নারায়ণের এই কথাগুলো শুনতে শুনতে এয়ারপোর্ট চলে এলাম। আমার কেন যেন নারায়ণের প্রতি তীব্র ভালোবাসা জন্মাচ্ছে। আর মনে পড়ছে, প্রথম দিনের সেই লোকটির কথাও। যে বলেছিল, মনে রেখো ‘৪৭-র আগে আমরা সবাই এক ছিলাম।

আমার লাগেজ নামিয়ে দেয়ার পর আমি নারায়ণকে আবার এক হাজার রুপি দিলাম। এটা দিতেই সে না নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল, দাদা আমার স্ত্রী ভয়ে রাগারাগি করে। এই যে আমাদের দেশে এনআরসি নিয়ে কত আন্দোলন চলছে। হিন্দু-মুসলিম মারামারি করছে। ধর্মের রাজনীতি চলছে। আমার স্ত্রীর ভয়, একদিন বলবে যত পরিবার ওই সময় ওই দেশ থেকে এসেছে কেউ এ দেশের নাগরিক নয়। যাদের পূর্বপুরুষ বঙ্গদেশের, তারা ভারতীয় নয়। এসব নিয়ে ভয় পায়। কী করবো দাদা? ভয় তো পাবেই। আমি যে দেশহারা। সে বেদনা আমার স্ত্রী তো বোঝে। নিজের সন্তানদের দেশ হারানোর বেদনায় ভাসাতে চায় না। এজন্য যত পারে আমাদের গল্পটা চাপা দিয়ে রাখতে চায়। যখন সে শুনেছে বাংলাদেশের কেউ আমাদের বাড়িতে আসবে- সেটা শোনার পর থেকে সে ভয় পাওয়া শুরু করেছে। তার ধারণা, পাশের বাড়ির লোকজন যদি দেখে ফেলে, তোমাদের বাড়িতে বাংলাদেশের লোক কী করে? তোমরা কি ওই দেশের? তখন তো এক মহাবিপদও হতে পারে।

আমাদের ক্ষমা করে দিও দাদা। ‘৪৭ শুধু দেশভাগ করে নাই, মানুষ ভাগ করে দিছে, স্বাধীনতার নাম দিয়ে মানুষরে দেশহারা করে দিছে। আপনার এই টাকা লাগবে না দাদা। আপনি দেশে যান। মাঝে মাঝে বুড়িগঙ্গার দিকে তাকাইয়া আমার কথা ভাইবেন, এই বঙ্গ যেন ভাগ না হয় এজন্য আমার পরিবারের একজনের অবদান আছে। বঙ্গ ভাগ হয় নাই ঠিক, কিন্তু ধর্মের নাম দিয়া দেশ ঠিকই ভাগ হইয়া গেছে। এই কষ্ট যে কত বড় কষ্ট দাদা, বুঝবেন না।

নারায়ণকে আমার খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে কষ্টে-অভিমানে পাগল হয়ে আছে। মেঘ জমে ছিল, এখন ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি হাত মিলিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে গেলাম। ইমিগ্রেশনে ঢোকা মাত্র প্রথম দিনের সেই অফিসারের কথাও মনে হলো। নিশ্চয়ই তারও এমন কোনো গল্প আছে। এই যে এনআরসি, এই যে ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের সীমানা কাটাকাটি, মানুষে-মানুষে মারামারি, তা যে যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় ক্ষত তৈরি করে রেখেছে তা কখনও কি রাষ্ট্র বুঝবে? নতুন মোড়কে বারবার হাজির হয় ধর্ম এখনো।

এই ভূখণ্ডের অনেকেই তো দেশহারা। নারায়ণের মতো কিংবা আমার মতো। দাদার কাছে কত শুনেছি হুগলির কথা। দাদাও তো নারায়ণের মতোই বলতো, হুগলিতে আমাদের বাড়ি আর এখানে বাসা। হাজারো-কোটি লোকের রক্ত ঝরিয়ে, বাড়ি হারিয়ে দেশ হলো। কিন্তু তবুও দেশে কেউ যেন বাড়ির স্বাদ ফিরে পেলো না। তাদের কাছে দেশটা বাসা হয়েই রয়ে গেলো।

গল্পটি সমকালের কালের খেয়ায় পূর্ব প্রকাশিত। লিংক: দেশ

গল্প: দেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top