সিদ্দিক বারমাকের যুদ্ধ এবং ‘ওসামা’

আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র ওসামা

জঙ্গিদের বিমান যখন হামলে পড়ে টুইন টাওয়ারে, ঠিক তখন বিশ্বের কাছে অন্য রকম পরিচয় পায় আফগানিস্তান। একসময়ের আধুনিক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরিণত জঙ্গিদের আস্তানায়। যার মূল ওসামা বিন লাদেন নামক এক ব্যক্তি। যার থাবায় আধুনিক আফগানিস্তানের পতন হয় নব্বই দশকের মাঝামাঝি। বিশ্ববাসী এসব নিয়ে খুব একটা ভাবেনি। কিন্তু যখন টুইন টাওয়ার ধসে পড়ল, মূলত তখন থেকেই তালেবানের ভয়াবহতা গণমাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করে।

আর এই তালেবানি শাসনের মধ্যেও কেউ কেউ শিল্পচর্চা করে গেছেন। কেউ গল্প লিখেছেন, গান লিখেছেন, গেয়েছেন, কবিতা লিখেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখে গেছেন। তাঁদেরই একজন ওসামা চলচ্চিত্রের পরিচালক সিদ্দিক বারমাক।

মস্কো থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সিদ্দিক বারমাক চলচ্চিত্র বানানোর লক্ষ্যেই জীবনের অর্ধেক সময় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার করেছেন। অবশেষে ২০০৩ সালে তাঁর নির্মিত ওসামা চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বে সাড়া জাগায় তাঁর এই চলচ্চিত্র। বিশ্ব তখনো শুধু সেখানে জঙ্গি তৎপরতা নিয়েই কথা বলছে। সেখানে তালেবান শাসন করেছে, ধর্মের নামে অত্যাচার-নিপীড়ন করেছে, সেসব গল্পেরই ঢোল বাজাচ্ছে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো। কিন্তু ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে ছিল, সে গল্প বলতে গিয়েই আফগান নারীদের এক অন্য রকম সংগ্রামের চিত্র দেখে বিশ্ববাসী। নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়, সিদ্দিক বারমাক নব্বই দশকের ইরানের চলচ্চিত্রের ধারাকেই অনুসরণ করেছেন। ইরানি চলচ্চিত্র যেমন নিজ দেশের বাস্তব সমাজব্যবস্থাকে তুলে ধরা শুরু করেছিল, ঠিক সেই পথকেই বেছে নেন সিদ্দিক বারমাক। তালেবান শাসনকালে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সিদ্দিক।

বারমাকের সংগ্রাম

সিদ্দিক বারমাক ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন। নিজের দেশের করুণ পরিণতি তিনি কিছু আঁচ করতে পারলেও ১৯৭৯ সালে তিনি মস্কো ফিল্ম স্কুলে পড়ার জন্য বৃত্তি লাভ করেন। সেখানে পড়াশোনা করে নিজ দেশেই ফিরে আসতে চেয়েছিলেন বারমাক। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে তালিম নিয়েছেন। গভীর মনোযোগের সঙ্গে রাশিয়ান সিনেমাকে পড়েছেন, জেনেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে গেছেন। পড়া শেষ করে দেশে ফিরবেন এমন আশা ছিল শুরু থেকেই। কাছে বন্ধুদের প্রায়ই বলতেন, গান্ধী যদি নিজ দেশে ফিরে আসতে পারেন, হো চি মিন যদি প্যারিসের বিলাস জীবন ছেড়ে সংগ্রামের উদ্দেশ্যে নিজ দেশে যাত্রা করতে পারেন, তবে আমি কেন পারব না

Siddiq Barmak

অথচ তিনি জানতেন, তৎকালীন সময়ে আফগানিস্তানের চলচ্চিত্রকে কঠোর সেন্সরের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তবুও তাঁর লক্ষ্য ছিল অটুট। 

পড়াশোনা শেষে তিনি কোর্সের অংশ হিসেবে দি আউটসাইডার নামে ৪০ মিনিটের একটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করেন। এই ছবি ছিল অফিসের প্রধান কর্তার সঙ্গে তাঁর কর্মীর মানসিক দ্বন্দ্ব নিয়ে। কী ধরনের অত্যাচার সহ্য করতে হয় অফিসের সাধারণ কর্মীদের, এ বক্তব্যই তিনি পেশ করতে চেয়েছেন দর্শকের কাছে। সত্যি কথা বলতে, এটি ছিল নিজ দেশেরই শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের চিত্র।

তিনি এই ছবি আফগানিস্তানে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পুতুল সরকার বারমাকের ছবিটি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসে। 

তবুও নিরাশ হননি বারমাক। তিনি অবিচল তাঁর লক্ষ্যে। নিজ দেশের সিনেমা হলে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হবেই। এই স্বপ্নে বিভোর তিনি। তিনি বরং আরো একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন। সেটিও প্রদর্শিত হয়নি। এতসব নিষেধাজ্ঞার পর আর্থিক সংকটে পড়ে যান বারমাক। এর পর আরেক সংগ্রামে লিপ্ত হন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দেন পরবর্তী ফিচার ফিল্মের অর্থ জোগানের। এমনকি পাকিস্তানেও যাত্রা করেন। ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান ১৯৯০-এর পর থেকে। লক্ষ্য একটিই, অর্থ জোগাড়। দুই বছর পর ১৯৯২ সালে তিনি কাবুল ফিরে আসেন। তখন আফগানিস্তানের অবস্থা টালমাটাল। তালেবান তখন ধীরে ধীরে ক্ষমতার খুব কাছে। তালেবান একদিন বারমাকের বাসায় হামলা চালায়। এতে নিহত হয় তাঁর সদ্য জন্মগ্রহণ করা ছেলেসন্তান। তাঁর ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। 

জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সব চেষ্টা তখনই বারমাকের মধ্যে। তিনি কাবুল থেকে চলে যান অন্য শহরে। সেখানেই ওসামা ছবির বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। 

ওসামা ছবিটি মূলত সত্য ঘটনার অবলম্বনেই তৈরি। যখন বারমাক বিবিসি পাকিস্তান শাখায় কাজ করেন, তখন সেখানে বসে কাবুলের একটি ঘটনা প্রকাশ হয়। পত্রিকার সেই রিপোর্টে বলা হয়, একটি মেয়ে স্কুলে যায় ছেলে সেজে। এই ঘটনাটিই বারমাক টুকে রাখেন। তাঁর ভাবনায় এভাবেই তৈরি হতে থাকে ওসামা। তারপর ১৯৯৬ সালের পর সব ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রদর্শন বন্ধ করে দেয় তালেবান। কিন্তু সুদিনের অপেক্ষায় রয়ে যান বারমাক। ২০০২ সালে বারমাক আবারো কাবুল ফিরে আসেন। এসেই তিনি বিস্মিত হয়ে যান। তিনি দেখেন, নারীদের শুধু স্কুল নয়, কাজ করার অধিকারও হরণ করে রাখে তালেবান। বিষয়টি বারমাককে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। তিনি তখন নতুন করে ভাবতে থাকেন। সে সময় প্রতিদিন তিনি রেডিও শুনতেন, যেখানে একজন মোল্লা ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ করতেন। কিন্তু বারমাক অদ্ভুতভাবে লক্ষ করেন, এই মোল্লা আসলে ধর্মীয় শিক্ষার নামে যৌন বিষয়ে জ্ঞান দেন। আর প্রায়ই পুরুষাঙ্গ কীভাবে পরিষ্কার করতে হয়, সে বিষয়ে কথা বলেন।

আর সঙ্গে সঙ্গেই ওসামা চলচ্চিত্রের সব চরিত্রই নির্মাণ করে ফেলেন বারমাক। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বারমাককে। তাঁর স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়। ওসামা চলচ্চিত্র ২০০৩ সালে কান উৎসবে মুক্তি পায়। পেয়ে যায় কান জুনিয়র অ্যাওয়ার্ড এবং গোল্ডেন ক্যামেরা-স্পেশাল মেনশন বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। বুসান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার ঘরে নিয়ে যান আফগান এই নির্মাতা। একই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের নতুন স্বপ্নের বীজও তৈরি করে দেন সিদ্দিক বারমাক।

কী ছিল ওসামা চলচ্চিত্রে

ছবির শুরুই করা হয় নীল বোরকার আড়ালে থাকা নারীদের একটি মিছিল দিয়ে। যেখানে নীল বোরকার নারীরা নিজেদের কাজের অধিকার চেয়ে আন্দোলনে নেমেছে। তারা ক্ষুধার্ত। তাই তাদের কাজ প্রয়োজন। আর তালেবানি শাসনে নারীদের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের দৃষ্টিতে নারীদের বাইরের কাজ করা নিষিদ্ধ। রোজগার করবে পুরুষ, নারীরা থাকবে ঘরে। দেখানো হয়, নারীদের সেই মিছিলে কী করে তাণ্ডব চালায় তালেবান সৈন্যরা।

পরিচালক কেন এমন আন্দোলন দেখালেন, তা খুব দ্রুতই উন্মোচন হয়। শুরু হয় এমন এক পরিবারের গল্প, যেখানে কোনো পুরুষ সদস্য নেই। আছে দাদি, মা ও মেয়ে। এই তিন চরিত্রকে দিয়েই পরিচালক বিশ্বকে দাঁড় করিয়েছেন এক অমানবিক বাস্তবতার সামনে। ওই পরিবার যদি কাজ না করে, তবে খাওয়া জুটবে কোথা থেকে? তালেবানের অমানবিক আইন কি তবে না খেয়ে মরার কারণ হয়ে দাঁড়াবে?

চলচ্চিত্র ওসামা

গল্পে দেখা যায়, মা যে হাসপাতালে কাজ করে, তার অবস্থা করুণ। তার ওপর হাসপাতালটি বন্ধও করে দিচ্ছে তালেবান। সেখানে নার্সের কাজ করে মা। মেয়েকে নিয়ে সেই হাসপাতালে যখন যায় তখনই সে জানতে পারে, হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। এমন সময়ে এক রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে। চিকিৎসা শুরু করে মা। কিছুক্ষণ পরই তালেবান হাসপাতালে আসে। বোরকার নিচে ঢুকে পড়ে মহিলাটি। তালেবানের প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধ রোগীর ছেলে নার্সকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। এর মধ্যে পরিচালক অসাধারণ এক বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বোঝাতে চান, তালেবানি শাসনে অতিষ্ঠ সাধারণ জনগণ তখনো একে অপরের পাশেই আছেন। তাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। বিপদে তারা একে অপরের পাশে ঠিকই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।

বাস্তবতার চিন্তায় যখন জীবনের প্রতি সব মায়া ত্যাগ করতে প্রস্তুত মা, তখন তার বৃদ্ধ মা নতুন এক বুদ্ধি আঁটেন। ঘরের কন্যাশিশুর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। কাবলি পরিয়ে দেওয়া হয়। রাতারাতি যেন এক নতুন রূপে হাজির হয় ছবির প্রধান চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিশু শিল্পী মারিনা গুলবাহারি। ছেলে সাজে তার নাম হয়ে যায় ওসামা। এ যেন জীবনের সঙ্গে নতুন ভয়ংকর খেলা দেখান পরিচালক। টিকে থাকার শেষ চেষ্টাই ছিল নারীকে পুরুষ করে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া। ওসামা তখন কাজ পায়, কাজ করে। 

Mollah

কিন্তু তালেবানের চোখ পড়ে ওসামার ওপর। কারণ, কাবুলের শিশুদের নিয়ে তারা তালেবান বানায়। তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের নিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। এক মোল্লা তাদের পুরুষাঙ্গ কী করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়, সেটাও শেখায়। বলা হয়, ভালো মুসলিম পুরুষ তাদের পুরুষাঙ্গকে পরিষ্কার করে প্রতিদিন।  ওসামা তো মেয়ে। তার সেই প্রশিক্ষণে জামা খুলতে লজ্জা হয়। তবুও তাকে খুলতে হয়। তার আচরণে মেয়েলি ভাব আছে। সেটাও স্পষ্ট হয়। মোল্লার নজরে সে পড়ে যায়। তখন মোল্লা বলে ওঠে, এই ছেলের মধ্যে বেহেশতের সেসব পুরুষের উপাদান আছে, যারা আসলে পুরুষ কিন্তু দেখতে নারী। এক কু-নজরের ইঙ্গিত বোঝান পরিচালক। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি ওসামার। তাকে ধরা পড়তেই হয়। শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসে সেই মোল্লা। কিন্তু জীবন কি এতই সহজ? মোল্লার লোভ যৌনতায়।

এক অসাধার‌ণ বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন পরিচালক সিদ্দিক বারমাক। তিনি এই ছবিটি দারি ও ফার্সি ভাষায় লিখেছেন। পরিচালনা ও সম্পাদনার টেবিলেও ছিলেন তিনি। সংগীত করেছেন মোহাম্মদ রেজা দারউইশি। কাবুল অসাধারণ চিত্রকে সাজিয়েছে আকবর মাশকিনি। ৮২ মিনিটের এই চলচ্চিত্র আফগান ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবেও বিবেচিত হবে যুগ যুগ ধরে।

সিদ্দিক বারমাকের যুদ্ধ এবং ‘ওসামা’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top