কার্ল মার্কসকে চেনে না কে? পুঁজিবাদের উত্থানের এই সময়ে এমন প্রশ্ন কি করা যেতে পারে? যখন পুঁজিবাদ ঘিরে রেখেছে আমাদের, ঠিক তখন কার্ল মার্কসই তো একমাত্র বিষয় হওয়া উচিত ছিল। যে কিনা দেখিয়েছিল এই কানা গলি থেকে বের হওয়ার উপায়। এই যে করোনাকালে লাখ-লাখ-কোটি-কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে কিংবা পড়ছে- সেই শোষিত শ্রমিক শ্রেণি যারা এতকাল নিজের ঘাম বিক্রি করেছে পুঁজির কাছে। সেই পুঁজি যখন বিপদে পড়ে গেলো ঠিক তখন ছুড়ে ফেলে দিল শ্রমিকদের। অথচ ছুড়ে যেন ফেলতে না পারে, শ্রমিক যেন শিনা উঁচিয়ে নিজের অধিকারটা বুঝে পায় সেজন্যই তো দুনিয়ায় জন্ম হয়েছিল মার্কসের। কিন্তু হায় মার্কস দিয়ে আজকাল আর দুনিয়ার রক্ষা হয় না।
কার্ল মার্কসকে আমিও চিনি, নামে, কর্মে। তবে কখনও গভীরভাবে পাঠ করার সাহস হয়ে উঠেনি। তার কারণ হয়তো মার্ক ভক্তরাই। এরা মার্কসকে উচু শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এখনও যখন কার্ল মার্কস নিয়ে আলোচনা হয় সেখানে বক্তাদের আসনে থাকেন জ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তিরা। যেন, কার্ল মার্কসকে একমাত্র তারাই পাঠ করার ও ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা রাখেন। অথচ স্বয়ং কার্ল মার্কস লড়াই করে গেলেন সমতা রক্ষার স্বার্থে। সহজ ভাষায় সহজ কথায় কার্ল মার্কসের আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ কি হয়েছে কখনও? অর্থাৎ কার্ল মার্কসকে জানতে হলে আপনার তাঁর উপর বিস্তর পড়াশোনা প্রয়োজন। তার আর্দশ, চেতনা বুঝতে হলে মার্কসেই মগ্ন হতে হবে। তবে যাদের জন্য মার্কস লড়াই করলেন, যে শ্রমিককে তিনি দিতে চাইলেন ন্যায্য হিস্যা তাদের কাছে মার্কস পৌঁছাবে কীভাবে?
জ্ঞানী-পণ্ডিতদের কঠিন কঠিন তত্ত্ব বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করতে করতে জনমানুষ থেকে দূরে বহু দূরে রয়ে গেলেন মার্কস। অনেক সময় তো মনে হয় এই উচু শ্রেণিতে বাস করা লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা পুঁজিবাদীদের দালাল হয়ে মার্কসকে মুটঠিতে রেখে দিয়েছেন।
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার ‘কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশ হয়।
সত্যিকার অর্থে মার্কসকে নিয়ে বাজারে বইয়ের কমতি নেই। বহুভাবে বহু পর্যায়ে মার্কস পাঠ হচ্ছে এবং বিশ্লেষণও হচ্ছে। তবে কার্ল মার্কসের তত্ত্ব নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়েছে তার চেয়ে কম আলোচনা হয়েছে রক্ত মাংসের কার্ল মার্কসকে নিয়ে। জাকির তালুকদার তার ছোট্ট ভূমিকায় যথার্থই বলেছেন। ‘কার্ল মার্কসের মতো মানুষদের ব্যক্তিজীবন সবসময়ই আড়ালে চলে যায় তাদের কীর্তি এবং অবদানের বিশালতার কারণে।’
জাকির তালুকদারের গ্রন্থটি পড়ার পর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, কেমন ছিলেন ব্যক্তি কার্ল মার্কস?
বলতে হয়, প্রচণ্ড জ্ঞান পিপাসু, জেদি, একরোখা মানুষ। কাউকে হেও করতে দ্বিধাবোধ করেনি কখনও। যদিও পরিবারের প্রতি বিশেষ করে স্ত্রী জেনির প্রতি ছিল তার তীব্র প্রেম ও ভালোবাসা। পিতা-মাতার প্রতি তীব্র অনুভূতি থাকলেও কখনও প্রকাশ করেননি। হয়ত এই আক্ষেপ থেকেই এঙ্গেলসকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সত্যিকার আশীর্বাদপ্রাপ্ত ভাগ্যবান হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যার কোনো পরিবার নেই।’
যাহোক, জাকির তালুকদার ব্যক্তি মার্কসের জীবনের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যেখানে মার্কস কোনো ঈশ্বর নন। বরং একজন সাধারণের মতোই যার জীবন সংগ্রাম। যার রয়েছে দারিদ্র, রয়েছে রোগ-শোক, জেদ, প্রেম, বেদনা, জীবন সংশয়। ব্যক্তি মার্কস থেকে তার উত্থানের পেছনের মানুষগুলোকে এক সুতোয় গেঁথেছেন জাকির তালুকদার।
এই গ্রন্থে আমি জানতে পারি, মার্কসের বাবা শুধুমাত্র রাষ্ট্রে টিকে থাকার স্বার্থে বদল করেছেন ধর্ম। শুধু তাই নয়, যে কঠিন মার্কসের গল্প পড়ে এসেছি পুস্তকে, সেও কিনা প্রেমে পড়েছে? তাও সেই নারী মার্কসের বয়সে বড়? তাও আবার পালিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে গোপন রেখেছে দীর্ঘ সময়? এও কি মার্কস করতে পারে?
মেধাবী মার্কস প্রেমে পড়েছিলেন বন্ধুর বোন জেনির। সেই জেনিই ছিল মার্কসের সঙ্গী। যদি পড়াশোনার কথা বলতে হয়, তবে মনোযোগী মার্কস প্রথমে বন ইউনিভার্সিটি পরে বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে যান। সেখান থেকে আবার রওয়ানা দেন ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই থিসিস জমা দিয়ে ১৮৪১ সালের ১৫ এপ্রিল কার্ল মার্কস পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
প্রচন্ড হেগেলপন্থী হয়ে উঠছিলেন মার্কস। বাবা পছন্দ করেনি। তবুও মাত্র ১৯ বছর বয়সে পরিণত মার্কস যে নিজের দিশা খুঁজে পেয়েছে তা ঠিকই বোঝা যায়।
বারবার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। সবগুলো কারণ উপেক্ষা করা যেত, তবে কেন যেন মনে হলো নিজের পক্ষে কিছু না থাকলেই মার্কস সেখান থেকে সরে যাওয়ার তাড়না বোধ করছেন। কিংবা অস্থির এক চিত্ত তার ভেতর ঘুরাফেরা করতো। মার্কস এমনকি কোনো দেশেই ঠিক মতো সময় কাটাতে পারেননি। বারবার বহিষ্কার হয়েছেন রাজনৈতিক লেখালেখির কারণে। পত্রিকায় চাকরি করেছেন। পরে টিকে থাকার জন্য নিজেও পত্রিকা দিয়ে বসেন। তবে লাভ হয়নি। সেখান থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার লিখেছেন। ধুমপানে, মদ্যপানে ব্যস্ত মার্কস লেখায় কখনও অনিহা করেনি। মাঝে বন্ধুত্ব হয় এঙ্গেলসের সঙ্গে। সকলকে সমালোচনায় তীরবিদ্ধ করলেও একমাত্র এঙ্গেলসকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেছেন। তাকে সম্মান করতেন।
অনিয়ন্ত্রিত জীবনে অভ্যস্থ মার্কস জীবনে লেখা ছাড়া আর কিছু কি করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, মার্কস তাত্ত্বিক বিদ্যাকে তেমন পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করতেন তাত্ত্বিক বিদ্যাকে ব্যবহারিকে রূপ না দিতে পারলে সেই বিদ্যার মূল্য নেই। আর তাই তো শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কী করে অর্জন করা সম্ভব সেসব নিয়ে কাজ করে গেছেন, লিখে গেছেন। পুঁজিবাদকে সবচাইতে ভালো বুঝতে পারতেন মার্কস। কারণ কারো বিরুদ্ধে কথা বলতে হলে, তার সম্পর্কে সকল জ্ঞান থাকতে হয়।
এ প্রসঙ্গে গ্রন্থে বলা হয়েছে,
‘…মার্কস তার শত্রুকে যেমন চেনেন, শত্রুর শক্তি সম্পর্কেও সচেতন। তার সেই চিহ্নিত শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ এবং বুর্জোয়াকে তিনি কখনোই আন্ডার এস্টিমেট করেননি। কেউ কেউ তো এমনও বলেছেন, ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস বুর্জোয়াদের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন কাব্যিক ভাষায়। আপাতদৃষ্টিতে এবং বিচ্ছিন্নভাবে পাঠ করলে তেমনটাই মনে হবে- ….’
মার্কসও কখনও কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি। যার তত্ত্ব কিংবা বিশ্লেষণ তার অপছন্দ হয়েছে তখনই লিখে ফেলেছেন প্রবন্ধ কিংবা বই। একদম তুলোধুনো করে ছেড়ে দিতেন। আর এ জন্য অনেকেই তাকে অপছন্দ করতেন।
যেমন, হেইনজেনকে মার্কস বলেছিলেন অসভ্য ফিলিস্টিন। এর বিপরীতে হেইনজেন মার্কস সম্পর্কে লিখেন (১৮৬০), মার্কস হচ্ছে বেড়াল ও বনমানুষের শঙ্কর প্রজাতি, একজন সোফিস্ট, কেবলমাত্র দ্বান্দিক, মিথ্যাবাদী। ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই জানেন না। লোকে তাকে মনে রাখে কেবলমাত্র তার নোংরা হলদেটে গায়ের রঙের জন্য, কালো শয়তানি চুল-দাড়ির জন্য, কুঁতকুঁতে দুই চোখে শয়তানি আগুনের আভার জন্য।….’
ভাবা যায়? কীভাবে ব্যক্তি আক্রমণ হতো সেকালেও? তবে ব্যক্তি মার্কসকে পাঠ করতে গিয়ে বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী লেখালেখির পথটা কখনও মসৃন ছিল না। এক কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মার্কসকে। সরকারদের ষড়যন্ত্রে বারবার তার পত্রিকা বন্ধ হয়েছে, দেশ ছাড়া করা হয়েছে, বারবার তার লেখা সেন্সরের কবলে পড়েছে। কিন্তু মার্কসের উত্থান কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ মার্কস যে একাগ্রতা, মগ্ন লড়াইয়ে, তার গতি ক্ষিপ্র। ভেঙে পড়বার পাত্র তো সে নয়। তার চীর জীবনের সঙ্গী জেনি যেন তার শক্তি। সংসার সামলে জেনির লড়াইটাও যেন আলাদা পুস্তকের দাবি রাখি। হয়তো আছেও।
তবে রাগী, একরোখা মার্কস যেন কাউকেই তোয়াক্কা করতে চায় না। এটা দেখা যায় যখন ফ্রান্সে নিজ উদ্যোগে পত্রিকা দেন তখন কারো মতামতের জন্যও অপেক্ষা করেন না মার্কস।
এ প্রসঙ্গে গ্রন্থে রয়েছে, ‘এডিটোরিয়াল বোর্ড থাকলেও পত্রিকা চলতো মূলত মার্কসের একনায়কত্বের অধীনে। একথা এঙ্গেলস পর্যন্ত স্বীকার করেছেন। অবশ্য এ কথাটি এসেছে স্টেফান বর্ন নামক একজন লোকের সূত্রে। পরবর্তীতে তিনি মার্কসের শত্রুদের একজন হয়েছিলেন। তিনি পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাস পরে দপ্তরে গিয়েছিলেন। সেখানে মার্কসকে এমন একনায়কত্ব চালাতে দেখেছেন যে সবচাইতে অনুগত ব্যক্তিটিও মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য।… সবচাইতে তিক্ত মন্তব্যটি এসেছিল এঙ্গেলস-এর কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, মার্কস আদৌ সাংবাদিক নয়। কোনোদিন সাংবাদিক হতেও পারবে না। পত্রিকার লিডিং লেখাটা নিয়ে সে সারাটা দিন কাটিয়ে দেয়। যে কাজটা দুই ঘণটায় শেষ করা যায়, সেটাকে মার্কস এমনভাবে বারবার সংশোধন-সংযোজন করতে থাকে, যেন কোনো দার্শনিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছে।…’
মার্কস বেঁচে ছিলেন ৬৫ বছর। এই পুরো জীবনটা তার সংগ্রামের গল্পে ভরপুর। প্রচণ্ড দারিদ্র, অর্থকষ্টের মধ্যে থেকে মারা যেতে হয়েছে মার্কসকে। অথচ ২০০ বছর ধরে কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন কার্ল মার্কস? যার আদর্শে চলেছেন লেনিন, স্ট্যালিন এমনকি বর্তমান চীন। আমি বুঝি না আদৌ কি নিপীড়ন নির্যাতন করে মার্কসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়? মার্কস কি এই ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত? ওপার থেকে কি বলছেন কার্ল মার্কস?
যাইহোক, জাকির তালুকদারের কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন বইটিতে সহজ ভাষা বর্ণনা করা হয়েছে এমনটা বলবো না। অনেকক্ষেত্রে ঝরঝরে না হলেও পড়তে ভালো লাগে। যেভাবে মার্কসের জীবনের ভেতর প্রবেশ করেছেন লেখক, তার চেতনার জগত যেভাবে গঠন হয়েছে এসব সুন্দরভাবে বর্ণনা রয়েছে গ্রন্থে। যদিও অনুবাদের জন্য কিছু কিছু বাক্য মসৃণ বাক্য ছিল না। এমনকি লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণও কিছু কম রয়েছে। তবে এও বলতে হয়, লেখক খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন কার্ল মার্কসের ব্যক্তিজীবনকে।
ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মূল্য ৩০০ টাকা (গায়ের মূল্য)। বর্তমান সময়ে রকমারি থেকে সংগ্রহ করা তো যাবেই, একই সঙ্গে ঐতিহ্যের ফেসবুক পেজে ম্যাসেজ করে দিলেও তারা বাসায় পৌঁছে দেবে। সেক্ষেত্রে আগে বিকাশে টাকা পাঠাতে হবে।