‘কাস্টমারকে আজীবন ধরে রাখার উপায়’

২০০৫/২০০৬ সালের দিকে হবে। আমি ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বারিধারায় ক্যাম্পাস। আর বাসা ছিল তেজকুনিপাড়া। ফার্মগেট থেকে বাসে চেপে ভার্সিটি যাই। বিজয়-সরণীর সিগনালে বাস প্রায়-ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন হঠাৎ করে চোখ গেলো একটা বিলবোর্ডে। সেখানে লেখা ‘শেষ কবে শিশিরভেজা ঘাঁসে পা রেখেছিলেন?’

মুহূর্তে আমি একটা শিহরণ অনুভব করলাম। মনে পড়ে গেলো শৈশবে আমাদের কলোনির বাসার কথা।

কী আশ্চর্য! একটা বাক্য আজীবনের মতো মনে গেঁথে গেলো। (যদিও এই মুহূর্তে মনে নেই সেটা কোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, সম্ভবত শাইন পুকুর হবে কিংবা এই ধরনেরই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান)।

এটাকেই হয়তো বলা হয় ইমোশনাল মার্কেটিং। এই টার্মটা নিয়ে আমার তেমন জানাশোনা ছিল না। এবারের বইমেলায় মুনির হাসানের ‘ইমোশনাল মার্কেটিং’ বইটি প্রকাশ হওয়ার পরপরই কিনে পড়ে ফেললাম। পড়ার সময়ই আমার মনে পড়ে গেলো বাস থেকে দেখা সেই বিল বোর্ডটির কথা।

আসলেই তো, বিজ্ঞাপন বাজার শেষ পর্যন্ত আমাদের ইমোশনেই ধাক্কা দেয়। ওই ধাক্কায় নড়েচড়ে বসে আমরা পণ্য কিনে ফেলি।

যাহোক, মুনির হাসানের বইটি নিয়ে কীভাবে আলোচনা করবো সেসব নিয়ে বিস্তর ভাবলাম। সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় উদাহরণসহ বর্ণনায় লেখা বইটি নিয়ে আলোচনা করাটাও ভুল হবে। সবই যদি বলে দেই তবে বই কিনে কী লাভ! তাই না?

এজন্য বইটি নিয়ে আলোচনায় নিজের অভিজ্ঞতা জুড়ে দিয়ে বাড়তি একটা স্বাদ আমি নেব। এখন বইটি কিনে পড়া কিংবা না পড়া দুটিই আপনাদের সিদ্ধান্ত।

বই আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু বলে নেই। আমি অনেকদিন ধরে অনিয়মিতভাবে বই আলোচনা করি। আমার কাছে মনে হয়, বই আলোচনা হলো বই প্রচারণার অন্যতম অঙ্গ। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ হলেন রাজীব নূর ভাই। তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, যে বই তোমার ভালো লাগবে না সে বই আলোচনা করা বৃথা। তুমি আলোচনায় নানান অসঙ্গতি তুলে ধরলে। তাতে লাভ কী হলো? সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই না।

আমি রাজীব ভাইয়ের এই কথা কোনোদিন ভুলিনি। আজও যে বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে ভালো লাগে না, সেটা আমি শেষ করি না। রেখে দেই। কারণ সময়ের তো মূল্য আছে, নাকি?

মুনির হাসান মানে মুনির ভাইয়ের বইয়ে আসি। বইয়ে একটা সাবানের বিজ্ঞাপনের উদহারণ দিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেছিলেন। এটা একদম নিজের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি। ছোটবেলায় এই সাবানের বিজ্ঞাপন দেখেছিও। সেটা হলো অ্যারোমেটিক সাবান। বিজ্ঞাপনে বলা হতো, ‘১০০% হালাল সাবান’। এই একটি বাক্য পুরো বাজার মাত করে দিয়েছিল। এখনও মনে পড়ে আমাদের বাসায় লাইফবয় বাদ দিয়ে অ্যারোমেটিক জায়গা দখল নিলো।

‘ইমোশন’কে বুঝবেন কিভাবে সেটা ভাবছেন? ওই যে ‘হালাল’ শব্দ! যে দেশের বিশাল অংশ মুসলিম ধর্মপ্রাণ, তাদের কাছে ‘হালাল’ শব্দের ওপরে তো আর কিছুই নেই। না হয় মাঝে মাঝে একটু ঘুষ-দুর্নীতি করে কিছু মানুষ তবে খাদ্য হতে হবে হালাল, শ্যাম্পু, সাবানও হতে হবে হালাল।

অ্যারোমেটিক সাবানের বিজ্ঞাপনটি দেখতে পারেন লিংকে ক্লিক করে: অ্যারোমেটিক হালাল সাবান বিজ্ঞাপন

এখানে ফেয়ার লাভলির প্রসঙ্গও আনা যেতে পারে। এই ক্রিম মেখে ফর্সা হয়ে যাওয়ার মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মূল পুঁজি হলো ‘ইমোশন’। কিন্তু এখানে একটা অসততা আছে। সেটা হলো পৃথিবীর কোনো ক্রিম মেখেই আপনি ফর্সা হতে পারবেন না। অথচ দীর্ঘসময় এই মিথ্যার ওপর ভর করে ছিল ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। এই অসততা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। যেমন, এখন নারীরা যথেষ্ট সোচ্চার। ভারতে কিন্তু ‘ফর্সাকারী’ ক্রিমের বিজ্ঞাপন দিলে ৫ বছরের জেল। আমাদের দেশে সম্ভবত এমন আইন নেই। হলেও জানা নেই। আর যদি না হয়ে থাকে তবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

যেমন, মুনির ভাই তার বইয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, আবেগ দিয়েই কি তাহলে ক্রেতার সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করা যাবে?

এই প্রশ্নের উত্তরটা হলো, আবেগ অবশ্যই ক্রেতাকে আকৃষ্ট করবে তবে ক্রেতার সঙ্গে যেন দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তৈরি হয় সে দিকটিও মাথায় রাখা জরুরি। তাই সব-সময় ইমোশনাল মার্কেটিংয়ে সততারও প্রয়োজন বলে মনে হয়।

এত কথা বলার পরও কি সবাইকে সংজ্ঞা দিয়ে ইমোশনাল মার্কেটিং বোঝাতে হবে? তাহলে বইটি কিনে ২৩ নম্বর পৃষ্ঠা পড়ে নিন। ওখানে সুন্দর করে সংজ্ঞা দেওয়া আছে।

তার আগে অবশ্য ইমোশন বিষয়টা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকতে হবে। যা বইয়ে একটা চিত্রও তুলে ধরেছেন মুনির হাসান। এই চিত্রের একটা লিংকও দিয়েছেন। বইয়ে সাদাকালে চিত্র দিলেও আপনাদের জন্য আমি রঙিন ছবিটি তুলে দিলাম বুঝার সুবিধার্থে। এটাকে বলা হয়, প্লাচিকের আবেগের চাকা। বইয়ে এই চিত্রটি বাংলায় অনুবাদ করা আছে।

Search Results Web results Plutchik's Wheel of Emotions

ইমোশনাল মার্কেটিংয়ের টার্গেট অডিয়েন্স কারা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটা গল্প বলি। আমার একটা ফেসবুক পেইজ আছে (Sheriff Al Sire)। আমি যেহেতু অলস প্রকৃতির মানুষ তাই খুব বেশি এটাকে নিয়ে কাজ করি না। শুধু যখন মাঝে-সাঝে লেখা আসে তখন পেইজে শেয়ার দিই। একবার এক বইমেলার আগে আমার খুব কাছের বন্ধু বলল, তোর বইয়ের প্রমোশনের দায়িত্ব আমাকে দে, আমি করে দিচ্ছি। ফেসবুক বুস্টও দেব।

ফ্রি পেলে তো বাঙালি আলকাতরাও খায়, তাই না? বন্ধুকে বললাম, করে দে। তো, বন্ধু একদিন আমাকে ফোন দিলো। জিজ্ঞেস করলো, তোর বইয়ের টার্গেট অডিয়েন্স কারা?

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কী? গল্পের বইয়ের আবার টার্গেট অডিয়েন্স কারা হবে?

আমি সেটাই তাকে বললাম। সে কিছুতেই বুঝে না। খালি বলছে, না না, তুই একটা জিনিস লিখছিস সেটা তো সেলেবেল হতে হবে নাকি?

বুঝতেই পারছেন, আমি তাকে কোনো টার্গেট অডিয়েন্স বলতেই পারিনি। এবং সেও এতই হতাশ হলো আর আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি।

এর অর্থ হলো, যে কোনো কিছুরই টার্গেট অডিয়েন্স থাকতে হয়। না হলে যে কোনো উদ্যোগই বিফল হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আমি তো বইয়ের উদাহরণ দিলাম। বই সবসময় ব্র্যান্ড হয় না। সব সময় বইয়ের টার্গেট অডিয়েন্সও থাকে না। যেমন, মুনির ভাইয়ের এই গ্রন্থের কিন্তু টার্গেট অডিয়েন্স আছে। কারণ এটা একটা বিষয়ভিত্তিক বই।

আরো সহজ একটা উদহরণ দেই। আমি সবশেষ একটা লেখা খুব খেটেখুটে লিখলাম। সেটা হলো ১৯১৮ সালের মহামারি স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল? প্রায় ১০ দিন ধরে পড়াশোনা করে মনোযোগ দিয়ে এই লেখাটা লিখলাম। এখন এই লেখাটির টার্গেট অডিয়েন্স কারা? আমি সত্যিই জানি না।

কিন্তু এই যে আজ ইমোশনাল মার্কেটিংয়ের একটা বইয়ের আলোচনা করছি সেটার কিন্তু একদম স্পেসিফিক টার্গেট অডিয়েন্স আছে। যারা ইমোশনাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছেন, যারা ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন- তারা পড়তে পারে। আবার মার্কেটিং বিষয়ে যাদের আগ্রহ আছে তারাও পড়তে পারে। এছাড়াও যেহেতু মুনির ভাই তরুণদের সঙ্গে অসংখ্য অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে থাকেন, সেই তরুণরাও লেখাটি পড়তে পারে।

তার মানে বিষয়ের উপরই নির্ভর করবে আপনার টার্গেট অডিয়েন্স কারা হবে।

এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, ইমোশনাল মার্কেটিং কি সঠিকভাবে কাজ করবে? এখানেই নিজের অভিজ্ঞতা জুড়ে দিতে চাই। আমার খুব বাজে একটা স্বভাব আছে। সেটা হলো কারণে-অকারণে বই কেনা। দেখা গেলো আমি একটা বই কিনতে গেলাম কিন্তু নিয়ে এলাম ১০টা বই। এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১০টা বইয়ের মধ্যে ৪-৫টা বই পড়াই হয় না। এখন বই কেনার একটা ঝক্কি আছে। বই কেনার জন্য আজিজ সুপার মার্কেট যাওয়া একটা মহা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো যখন চাকরি জীবনে ঢুকে গেলাম। একদিন হঠাৎ জানতে পারলাম রকমারি নামে একটা সার্ভিস চালু হয়েছে। যারা বাসায় বই পৌঁছে দেয়। ওয়েবসাইটে ঢুকে নম্বর নিয়ে তাদের ফোন দিলাম বিষয়টা বোঝার জন্য। তারা আমাকে বলল, রাস্তায় জ্যামে বসে কষ্ট করে বই কেনার চাইতে আমরা আপনার বাসাতেই বই পৌঁছে দেব। আমি প্রায় এক মাস দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম সার্ভিসটি নিয়ে। কিন্তু অদ্ভুদ বিষয় হলো, অর্ডার দেয়ার দুইদিনের মধ্যে বাসায় গেলো বই। এখন এটাকে আমরা কি বলবো? বই হচ্ছে আমার একটা ইমোশন। আর জ্যাম হচ্ছে একটা সমস্যা। এই সমস্যাকে হটিয়ে দিলো রকমারি। তার মানে ইমোশন এভাবেই কাজ করবে।

রকমারি হলো বাংলাদেশের একমাত্র উদ্যোগ যার আসলে কোনো বড় সড় বিজ্ঞাপনে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তারা ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’ হয়েই পৌঁছে গেছে বইপ্রেমীদের কাছে। শুধু কি তাই? রকমারির মার্কেটিং করার তেমন প্রয়োজনও পড়ে না। যেমন, অনেক লেখক বলে দেন তার বইটি ‘ঘরে বসে পেতে ক্লিক করুন’ বলে রকমারির লিংক দিয়ে দেয়। এরপর প্রকাশকরাও অনলাইন থেকে বই কেনার জন্য রকমারির লিংক দিয়ে দেয়।  

আমি ব্যক্তিগত উদাহরণ সামনে হাজির করছি আর মুনির ভাইয়ের উদাহরণকে চাপিয়ে রাখছি তার একটা উদ্দেশ হলো, আপনার যদি আরও কিছু জানার আগ্রহ হয় তবে বইটি কিনে ফেলুন।

বইটিকে চারটিভাগে ভাগ করে সহজ ভাষায় এমনভাবে লেখা হয়েছে যে পড়তে পড়তে আপনিও লিখে ফেলতে পারবেন আপনার অভিজ্ঞতা। কারণ সব ঘটনাই আমাদের সবার জীবনে নানান ভাবে ঘটেছে। শুধু আমরা ধরতে পারিনি ইমোশনাল মার্কেটিং কোনটা ছিল। এছাড়াও বেশ কিছু কেস স্ট্যাডি সামনে হাজির করেছেন মুনির হাসান। যা সত্যিই বিস্ময় জাগানো বটে, একই সঙ্গে উৎসাহব্যঞ্জক। যেমন, ডলারসেভ ক্লাব নামে এক উদ্যোগের কথা কেস স্ট্যাডিতে আলোচনা হয়েছে। একটা সাধারণ উদ্যোগ কী করে মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেতে পারে সেটা না পড়লে বোঝার উপায় নেই।

এছাড়াও ইমোশনাল মার্কেটিংয়ের তো কিছু টেকনিক আছে। যা ধরে আপনাকে এগুতে হবে। সেসব কিছু ধারণাও বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই বইকে আরও ইন্টারেস্টিং মনে হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, কিউআর কোড ব্যবহার। যখন যে বিজ্ঞাপনের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, তখন সেখানে কিউআর কোড দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাকে বলে অ্যানালগের মধ্যেও ডিজিটাল।

এখন আপনারা যারা উদ্যোক্তা হবেন কিংবা হয়েছেন তাদের জন্য অবশ্যই রসদ জোগাবে এই গ্রন্থটি। আমার লেখার শিরোনামটা কিন্তু বইয়ের সাব-টাইটেল থেকে নেওয়া। মানেটা খুব পরিষ্কার। ইমোশনাল মার্কেটিং মানে শুধু ক্রেতা কিংবা গ্রাহক পাওয়া নয়, তাকে আজীবন ধরে রাখার উপায়ও বটে। অতএব কাজে লেগে পড়ুন। বইটি অর্ডার দিয়ে পড়ে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন কী কী হয়ে গেছে আপনার জীবনে আর সামনে আপনি কী কী ও কীভাবে করতে পারেন।

‘কাস্টমারকে আজীবন ধরে রাখার উপায়’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top